ছাত্রসংগঠনগুলো হচ্ছে সব সরকারি দলের পাহারাদারছাত্রলীগ আবারও আলোচনায় এসেছে। গত পাঁচ-ছয় বছরে অধিকাংশ সময় তারা আলোচনায় ছিল নিন্দনীয় কাজ করে। সন্ত্রাস, ছিনতাই, অপহরণ, ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে নিজেদের মধ্যে খুনখারাবি করার। সম্প্রতি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েও ফ্রিস্টাইল বন্দুকযুদ্ধে তাদের একজন নেতা নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে সারা দেশে।
ছাত্রলীগের এসব অপকর্মের পর স্বাভাবিকভাবে নানা প্রতিক্রিয়া ঘটে। ছাত্রলীগের নেতারা, সংঘর্ষে জড়িত ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে বহিষ্কৃত বা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী বলে প্রচারণা চালান, কখনো গণমাধ্যমের বাড়াবাড়িতে বিরক্তি প্রকাশ করেন। ছাত্রলীগের বিবেকবান সাবেক নেতারা ছাত্রলীগ তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে বলে দুঃখ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতি আলোচিত ঘটনাগুলোতে অপেক্ষাকৃত কমজোরি নেতাদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে। পুলিশ অপরাধীদের কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানায়। যদিও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি প্রায় অবধারিতভাবে জামিন পেয়ে বের হয়ে আসেন।
বড় ধরনের সংঘর্ষ হলে টেলিভিশন বা পত্রিকায় নানা আলোচনা হয়। একদল ব্যক্তি বিএনপি আমলে ছাত্রদলের অপরাধবৃত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ছাত্রলীগের অপকর্মকে লঘু করার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের সরকারের সব মহান অর্জন ছাত্রলীগের কারণে রসাতলে যাচ্ছে বলে দুঃখ করেন। অন্যরা নানা পরিসংখ্যান আর অতীত ঘটনার রেফারেন্স টেনে ছাত্রলীগ যে সব দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
গণমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনায় কিছু বিষয়ে মিল থাকে অনেক সময়। যেমন, প্রায় সব পক্ষ সরকার কেন এখনো ছাত্রলীগের বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তার সমালোচনা করে। অনেকে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সবচেয়ে যা বিস্ময়কর, প্রায় সবাই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে ছাত্রলীগ হচ্ছে আওয়ামী লীগ বা সরকারের জন্য আপদ, বোঝা, বিষফোড়া!
কিন্তু আসলে কি তাই? আসলে কি ছাত্রলীগ শুধুই বিষফোড়া? ছাত্রলীগ যদি বোঝা বা বিষফোড়াই হয়, কেন আওয়ামী লীগ কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে? কেন দেশের প্রচলিত আইনের নাগালের বাইরে রাখা হয়েছে? কেন পুলিশের চোখের সামনে অস্ত্র বের করে গোলাগুলির সময়ও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করার সাহসই পায় না? কেন হাজারো অন্যায়ের সংবাদ পত্রিকায় প্রামাণ্যভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরও যথোপযুক্ত শাস্তি হয় না কারও?
এর সরল উত্তর হচ্ছে, ছাত্রলীগ আসলে আওয়ামী লীগ বা সরকারের বোঝা বা বিষফোড়া নয়, বরং সম্পদ। ছাত্রলীগ সরকারের কুশাসন আর মাঠ রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একাধিপত্যের ফুট সোলজার বা পাহারাদার।বিশেষ করে, শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়ার জন্য সদাজাগ্রত শক্তি। কুশাসনে অতিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে সরকারের প্রথম প্রতিরক্ষাবর্ম।
বিএনপির আমলে ছাত্রদলও তা-ই ছিল বিএনপির জন্য। নব্বই-পরবর্তী সময়ে দল দুটোর উত্তরোত্তর কুশাসন যত বেড়েছে, তার পাহারাদারির প্রয়োজন ততই বেড়েছে। এই পাহারাদার সশস্ত্র হলে ভালো। তাদের সামনে রয়েছে অবৈধ বিত্ত ব্যবসা, সুযোগ; প্রতিপত্তির প্রলোভন থাকলে আরও ভালো। কখনো নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে মারামারি হোক, কিন্তু সবাই নিজেদের দলে থাকলে সেও ভালো।
এমন নষ্ট সংস্কৃতিতে কিছু খুন-জখম অন্যায় হলে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারীদের মান-সম্মান সামান্য কমে বটে। কিন্তু বিনিময়ে নিজেদের ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি নিরাপদ থাকে। ক্ষমতা আর দাপট নিরাপদ রাখার প্রয়োজনটাই সবচেয়ে বেশি। এমন পুষ্টিকর নিরাপত্তা যারা দেবে, তারা কেমন করে বোঝা বা বিষফোড়া হয় সরকারের। বরং এরাই সরকারের অ্যাসেট বা সম্পত্তি! বিশেষ করে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে এর বড় প্রমাণ।
২.
বাংলাদেশে ১৯৪৮ সাল থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনগুলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আমলেও সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান সোচ্চার কণ্ঠ ছিল ছাত্রসমাজ, তৎকালীন বাম ছাত্রসংগঠনগুলো। একই ধারাবাহিকতায় জিয়া এবং এরশাদ আমলেও বহু সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল ছাত্রসংগঠনগুলো, আন্দোলনভূমি ছিল স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তে এই আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকা রেখেছিল কোনো কোনো ছাত্রসংগঠন—এমন ঘটনাও ঘটেছিল।
দুই নেত্রী তাই ভালো করেই জানতেন, দেশ পরিচালনায় কোনো ব্যর্থতার প্রধান এবং প্রাথমিক প্রতিরোধ আসবে শিক্ষাঙ্গনগুলো থেকে, বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে। প্রথম থেকে তাই নিজ দলের ছাত্রসংগঠনকে ক্ষমতার প্রহরী রাখার এবং বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোকে দমন করার কাজে ব্যবহার করতে সচেষ্ট ছিল দুই নেত্রীর সরকারগুলো। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে ছাত্রীমিছিলে ছাত্রদলের হামলা দিয়ে শুরু। তারপর ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বিএনপির শেষ আমলে ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থানের কিছুটা সুযোগ তবু দেওয়া হতো আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনকে। শান্তি বিঘ্নিত হলে, অর্থাৎ বিএনপির সরকারের বিরুদ্ধে জোরেশোরে আন্দোলনের চেষ্টা হলে ক্যাম্পাস থেকে মেরেকেটে বের করে দেওয়া হতো ‘শান্তির শত্রুদের’।
আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে অবস্থা আরও ভয়াবহ। শিক্ষাঙ্গনে ‘শান্তি ও শিক্ষার পরিবেশ’ বজায় রাখার স্বার্থে প্রধান বিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের অস্তিত্বই নির্মূল করা হয়েছে এখন। স্বকীয় ধারার বাম সংগঠনগুলোকে কার্যক্রম চালাতে হয় নির্দিষ্ট গ-ির মধ্যে। এমন একটি সংগঠন কর্তৃক ভারতের বাংলাদেশ নীতির বিরুদ্ধে কর্মসূচি পর্যন্ত হামলা চালিয়ে প- করে দেওয়া হয়েছে ভারতের পরম বন্ধু এই সরকারের আমলে! সেও আবার মুক্তবুদ্ধি চর্চার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন আরও নানাভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করে সরকারগুলোকে। বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পাসে একাধিপত্য বজায় রাখার সুবাদে সরকারের পক্ষে মিটিং-মিছিলে সাধারণ ছাত্রদের অংশ নিতে বাধ্য করে এরা, বিশেষ বিশেষ নেতার পক্ষে ছদ্মভাবে হলেও ছাত্রদের ব্যাপক সমর্থনের আবহ সৃষ্টি করে, সরকারের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকা-ের দায়ভার থেকে রক্ষা করে। ছাত্রজীবন শেষ হলে বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে ঢুকে আমলাতন্ত্রে সরকারের প্রভাব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
কুশাসন, দলীয়করণ ও বিভেদের রাজনীতিতে এভাবেই বিরাট সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগ ও খালেদা জিয়ার বিএনপির গণতন্ত্রের লেবাস খুবই উজ্জ্বল। এরা জাতীয় পার্টি নয়, জামায়াতে ইসলামীর মতো ধিক্কৃত স্বাধীনতাবিরোধী দলও নয়। ফলে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সরকারের পাহারাদারেরা (সেটি ছাত্রসংগঠন, যুবসংগঠন বা পেশাজীবী সংগঠন যা-ই হোক না কেন) যতই অন্যায় করুক, খুব একটা অসুবিধা হয় না তাদের। সমাজের বিবেকবানেরা একসঙ্গে সোচ্চার হয়ে ওঠেন না এদের বিরুদ্ধে।
৩.
সমস্যা হচ্ছে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল তাদের আমলে নিজ সরকারের পাহারাদারের ভূমিকা পালন করেছে জনপ্রিয়তার জোরে নয়। বরং বাহুবলে, কখনো অস্ত্রবলে, অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে। এই সন্ত্রাসতন্ত্র ক্যাম্পাসগুলোতে বহু বছর ধরে চলে আসছে সরকার, সরকারের সাজানো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকারের ক্রীড়নক পুলিশের নানা ধরনের অবৈধ বা অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জোরে। পাহারাদারের বেতন থাকে। সরকারের ছাত্রসংগঠনের জন্য থাকে লুটপাট, চাকরি আর ব্যবসার অবাধ সুযোগ। সুশাসন দিয়ে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ সরকারগুলো এই স্বার্থচক্রকে কেন ভেঙে দেবে? কেন আওয়ামী লীগ বা বিএনপি তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোকে বিযুক্ত করবে? কেন শাস্তি দেবে তাদের কখনো অন্যায় করার জন্য?
এই দল দুটো এমনকি আগ্রহী নয় সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতিতেও। ওপর থেকে এরা চাপিয়ে দেয় ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগ চক্ষুলজ্জার খাতিরে হোক, দলের একসময়ের ঐতিহ্যের কারণে হোক, কিছুটা গণতন্ত্রচর্চা ও নেতৃত্বের নবায়নের সুযোগ দেয় তার ছাত্রসংগঠনে। বিএনপির সেই চক্ষুলজ্জাও নেই। তবে সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতির জন্য আরেকটি বড় যে শর্ত, সেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দুটো দলেরই রয়েছে একই রকম প্রবল অনীহা। ডাকসু, চাকসু, রাকসু নির্বাচন হলে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের জিতে আসার আশঙ্কা থাকে, ক্যাম্পাসে একাধিপত্য ভেঙেচুরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার নিজ ছাত্রসংগঠনের কেউ বিজয়ী হলেও জনসমর্থন ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতার জোরে তার মধ্যে স্বকীয় সত্তার জাগরণের ভয় থাকে। এই সত্তাকে বড় ভয় পায় দেশের বড় দুটো দল। তাই স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, কিন্তু গণতন্ত্রের দুই যুগে একবারও অনুষ্ঠিত হয় না ছাত্র সংসদ নির্বাচন, অদূর ভবিষ্যতে তা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
কাজেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের রয়েছে বহু ত্যাগী, আদর্শবান কর্মী। কিন্তু অতিচালাক যারা, তারা জানে অন্যায় করার বা তা অন্তত সহ্য করার যোগ্যতা না থাকলে ছাত্রদল বা ছাত্রলীগে বড় পদ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সাধারণ ছাত্রদের অনেকে জানে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের ফরমায়েশি মিটিং-মিছিলে অংশ না নিলে ভবিষ্যতে চাকরি-বাকরি দূরের কথা, ছাত্রাবাসগুলোতে থাকার জায়গা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
দোষ আসলে তাই সরকারের। বিএনপি আমলে বিএনপির সরকারের, আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগের সরকারের। তাদেরই স্বার্থে ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে এরা। আগুন নিয়ে খেললে সে আগুনে মাঝেমধ্যে নিজের হাত পোড়ে। যে আগুনে নিজের হাত পোড়ে, সে আগুন নিভিয়ে দেন তাঁরা। যে আগুন সরকারবিরোধীদের পুড়িয়ে মারে, সে আগুন নানাভাবে লালন করেন তাঁরা। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ উৎসাহদাতা মন্ত্রীর তাই শাস্তি হয়নি, শাস্তি হয়েছে ফুট সোলজারদের। সেও খুবই প্রকাশ্যে, খুবই প্রামাণ্যভাবে হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা সারা দেশের মানুষ দেখে ফেলার জন্য, এই অন্যায় আড়াল করার কোনোই সুযোগ ছিল না বলে।
বাদবাকি হত্যাকাণ্ডে বা অন্যায়ের বিচার হয়নি, কেউ এসবের জন্য দণ্ডিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর, জাহাঙ্গীরনগরে জুবায়ের, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুমন দাস হত্যাকাণ্ডে জন্য কেউ কেউ সাময়িকভাবে বহিষ্কার হতে পারেন, কিন্তু দেশের আইনে কঠোর শাস্তি পাবেন না সম্ভবত।
ক্ষমতার মালিকেরা কখনো প্রকৃত শাস্তি দেবেন না ক্ষমতার পাহারাদারদের।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।