ব্রেকিং নিউজ
Home / নির্বাচিত কলাম / আমাদের রেহানা আপার কথা

আমাদের রেহানা আপার কথা

।। আকবর হোসেন।। আমাদের রেহানা আপা আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। গতকাল (১৭ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার) ভোরে তিনি মৌলভীবাজার, গুজারাই গ্রামে নিজ বাসভবনে হঠাৎ করেই ইন্তেকাল করেন। বয়স আর কতো হবে? ষাট তখনো পার হয়নি। হাই ব্লাড প্রেসার ছাড়া অসুখ বিসুখও তেমন কিছু ছিলো না। তাতে কী? জন্ম-মৃত্যুর উপর তো মানুষের কোন হাত নেই। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে, মা ভাইবোন আত্মীয়স্বজনসহ অনেক গুণগ্র্রাহী রেখে গেছেন।
আজকাল ইন্টারনেটের যুগে ভালো মন্দ খবর পেতে কোন দেরি নেই। আমাদের ফ্যামিলি হোয়াইটআপ গ্রুপেই খবরটি জানায় আমাদের ভাগিনা (খালাত বোন শাহিনার বড় ছেলে) সাইফুল ইসলাম বিপ্লব (লন্ডনে এমবিএ অধ্যয়নরত)। সাধারণতঃ রাতে ফোন সাইলেন্টেই থাকে। কিন্তু ফজরের নামাজের পর একবার হোয়াটসআপ গ্রুপগুলো, বিশেষ করে ফ্যামিলি গ্রুপটি একবার দেখে নেই এবং সে সাথে অন্যান্য ম্যাসেজেও চোখ বুলাই। আজও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। কে জানে আজকের ম্যাসেজে এরকম একটি মৃত্যু সংবাদ থাকবে! অবশ্য এখন প্রতিদিনই কারো না কারো মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়। করোনার কারণে এ সংখ্যা যেনো বেড়েই চলেছে। তার অকাল মৃত্যুতে আমরা খুবই মর্মাহত। কাল সারা দিনেই আপার কথা মনে পড়েছে।
রেহানা আপা ছিলেন আমাদের বড় খালার প্রথম সন্তান – বড় মেয়ে। আমাদের কাজিনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বড় খালার দুঃখের যেনো শেষ নেই। কবে যে অধিক শোকে পাথর হয়ে আছেন! কারণ আমাদের বড় খালু মরহুম আব্দুল মজিদ (বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ফুটবলার) আমাদের রানীগঞ্জ বাজারে (সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর) সংঘটিত ১৯৭১ সালের ১লা সেপ্টেম্বরের গণহত্যায় একজন শহীদ। আমার বাবা শহীদ আকলু মিয়ার (তৎকালীন বাজার কমিটির চেয়ারম্যান) সাথে তিনিও শহীদ হন। বড় খালুর লাশও খোঁজে পাওয়া যায়নি। এটি ছিলো খালার জন্য একটি বড় ধাক্কা। স্বাধীনতার পর (জানুয়ারী, ১৯৭২) জন্ম নেয় খালার ছোট মেয়ে শাহিনা। এই শাহিনার ছেলে হচ্ছে বিপ্লব। কিন্তু শাহিনাও দুই ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে প্রাণ হারায় ২০১১ সালে। আর কাল মারা গেলেন বড় মেয়ে। আল্লাহতাআলা তাদের সকলকে মাফ করে দিন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের বাসিন্দা বানান।
রেহানা আপার মৃত্যুতে আজ অনেক স্মৃতিকথাই মনে পড়ছে। বলা যায় ছোট বয়সেই আপার বিয়ে হয়। বিয়ের দিনের কথা এখনো মনে আছে। মৌলভীবাজার থেকে আগত বরযাত্রী মেহমানদের আমাদের বাংলাঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তখনকার দিনে রানীগঞ্জে গাড়িঘোড়া চলতো না। তারা শেরপুর থেকে লঞ্চে এসেছিলেন বিয়েবাড়ীতে। আমরা স্কুল ছুটিতে (১৯৭৮-১৯৮৩ আনুমানিক এই সময়ে) প্রায়ই বেড়াতে যেতাম মৌলভীবাজার আপার বাড়িতে। রানীগঞ্জ থেকে লঞ্চযোগে শেরপুর তারপর ঢাকাগামী কোচ কিংবা লকালে মৌলভীবাজার কুসুমবাগ। কুসুমবাগে তখন একটি সিনেমাহল ছিলো। এখন আর সেটি নেই। তারপর আল আমিন মিষ্টিঘর। কোচ থেকে নেমে সেখান থেকে কিছু খাওয়া ও নেয়া হতো। রিক্সাযোগে কিংবা হেঁটে পশ্চিম বাজার খেয়াঘাটে যেতে হতো। গুজারাই গ্রাম মনু নদী পার হয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই দেখা যায়। বর্ষায় মনু নদীর পানি উপছে পড়তো কিংবা হেমন্তে বলা যায় হাঁটু জল। আমরা রশি টেনে অনেক সময় নদী পার হতাম। বাড়ী ফেরার পর বড় খালাম্মাকে সব কথা বলা লাগতো। তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে রেহানা আপার কথা, দুলাভাইয়ের কথা, তার নাতিনাতনীর কথা জিজ্ঞেস করতেন। অনেক সময় আমরা তাতে বিরক্ত হতাম। কিন্তু এখন যখন সন্তানের বাবা হয়েছি তখন বুঝি সন্তানের প্রতি মা-বাবার কী পরিমাণ দরদ।
আপা, দুলাভাই (শামসুদ্দিন চৌধুরী), আমাদের খুবই আদর করতেন। তাদের বাড়িতে অনেক জাতের গাছ গাছালী ছিলো। আম, কাঁঠাল, সুপারী মেহগনি – কতো রকমের গাছ। সুপারী বাগানের কথা এখনো মনে আছে। সামনে পুকুর, পেছনে পুকুর। পুকুরে মাছও ছিলো। সামনে সব্জি খেত। পুরো বাড়িতে যেনো এক সবুজের সমারোহ। ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়‘ এই গ্রাম। শুধু তাদের বাড়িই নয় অন্যান্য বাড়িতেও প্রচুর গাছপালা দেখা যেতো। আজকাল সব জায়গায় গাছপালা উজাড় হচ্ছে। এতে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। নির্মল বায়ু সেবন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। সে যাক, তখনকার দিনে মৌলভীবাজারে লেইট নাইট শপিং এর প্রচলন ছিলো। আমরা দুলাভাইয়ের সাথে চাঁদনী ঘাটের মনু ব্রীজ পার হয়ে চৌমুহনীতে বাজারে যেতাম। ব্রীজে উঠার পর বেশ ভয় পেতাম। কারণ ব্রীজে উঠলেই ব্রীজ কাঁপতো; আমরা সেটা অনুভব করতাম, বুক দুরু দুরু করতো। ভাবতাম এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ছে। সংগ্রামের সময় ব্রীজের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়, এর পর থেকেই ব্রীজের এই অবস্থা ছিলো। মনে পড়ে দুলাভাইয়ের ছোট ভাই ওয়েস ভাই তখন কল্পনা সিনেমা হলের অপারেটর ছিলেন। বাজার খরচের ফাঁকে দুলাভাই আমাদের সিনেমাতে ঢুকিয়ে দিতেন। অবশ্য আমরাই চাইতাম সিনেমা দেখতে। সে সময় মালকা ভানুর ফিল্ম খুব হিট করেছিলো। সে যাক, বাজার সওদা করে বাড়িতে গভীর রাতে ফিরে আসতাম। আমরা প্রায়শঃই ঘুমিয়ে পড়তাম। আপা রান্নাবান্না করতেন। সে সময়ে রান্নাবান্না এতো সুখের ছিলো না। লাকড়ী দিয়ে চুলা জ্বলতো। আমাদের মাঐইও সজাগ থাকতেন এবং আমাদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাবার দিতেন। দুলাভাই আমাদেরকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন তার মামার বাড়ি চাঁদনী ঘাটে এমপি সাহেবের বাড়িতে, শাহ মোস্তফা রোডে, হসপিটাল রোডে, পার্শবর্তী উলুওয়াইল গ্রামের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে।
স্কুল ছুটি ছাড়াও অন্যান্য সময়েও মৌলভীবাজারে অনেক বেড়াতে গিয়েছি, বেড়ানোর সুযোগে আমাদের রানীগঞ্জ শহীদ-গাজী লাইব্রেরীর জন্য বই পুস্তক কিনতেও হতো। সে সময় মৌলভীবাজারে শ্রীলক্ষী লাইবেরীর খুব নামডাক ছিলো। কিন্তু কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা ও পরবর্তীতে দেশের বাইরে চলে আসায় মৌলভীবাজারে আর তেমন যাওয়া হয়নি। এখনতো অনেক পরিবর্তন। দেশে গেলে আপা দুলাভাই সবাই আসতেন। তখন আমার খুবই ভালো লাগতো। এইতো সেদিনও আপা ও দুলাভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। দেশে গেলে তাদের বাড়িতে যেতে বলেছেন। কিন্তু সেদিন আর আসবেনা। আপার সাথে আর দেখা হবে না।
রেহানা আপাকে সবাই আদর করতেন। আম্মা, আব্বা, চাচা সবার কাছেই তিনি ছিলেন খুবই প্রিয়। আপা নাকি ছোট বেলায় গরম গরম চা পান করতেন। বড়দের সাথে চায়ের পেয়ালা হাতের কাছে পেলেই শেষ। তিনি চোখের পলকেই যেনো শেষ করতেন। রানীগঞ্জে আমাদের বাড়ি ও বড় খালাম্মার বাড়ি পাশাপাশি ছিলো। তখনকার দিনে বাজার ছিলো একটু দুরে। দুই বাড়ির মাঝখানে ছিলো ছোট্ট খেত, আমাদের কাছে ‘বিছড়া‘ বলে পরিচিত। এটি পাড়ি দিলেই খালাম্মার বাড়ি। আমরা ভাইবোন সবাই মিলে বরই গাছ, শপড়ি গাছ, সুপারী গাছ, চড়াচড়ি, বরই পারা, মাছ ধরা, ডাং ডিং খেলা, গুলাইল দিয়ে পাখি শিকার, বাজার থেকে লাকড়ি কুড়ানো, সিগারেটের বাক্স দিয়ে খেলা, মার্বেল খেলা, গুড্ডি উড়ানো, মেলায় যাওয়া, চড়ুই ভাতি খেলা, পুতুল খেলা ইত্যাদি কতকিছু করতাম। এ সবই আজ মনে পড়ছে। দুস্তপুরে মামার বাড়িতে যাওয়ার দিন আমাদের যেনো আনন্দের কোন সীমা থাকতো না। মনে পড়ে বড় খালাম্মা অনেক আগেই তৈরি হয়ে যেতেন। কিন্তু আম্মা আমাদের তৈরি করাতে অনেক সময় লাগতো। তাছাড়া আমরা যাবো কী যাবো না এ নিয়েও দুদোল্যামানতা চলতো অনেকক্ষণ। তারপর একসময় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতো; প্রায় আসরের সময় আমরা হেঁটে রওয়ানা দিতাম হেমন্তকালে আর বর্ষাকালে তো নৌকা ছাড়া উপায় ছিলো না।
কথা হলো পাভেলের সাথে। রেহানা আপার ছোট ছেলে, আমাদের ভাগিনা এখন ফ্রান্সে আছে, ডিপ্লোমা করছে। তাকে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। নিজের কান্নাই ধরে রাখতে পারছি না তাকে স্বান্তনা দেই কিভাবে! উনার বড় ছেলে জুবেল আছে দুবাইতে, বড় মেয়ে সেন্টু ও ঝিনুক দেশে এবং ছোট মেয়ে নিজু আছে কার্ডিফে। বড় খালাম্মার জন্য এটি একটি কঠিন সময়। আমাদের স্বান্তনা জানানোর কোন ভাষা নেই। খালাম্মার মৌলভীবাজারের সাথে খুব বেশি যোগাযোগ ছিলো। বড় মেয়ের প্রতি একটু বাড়তি মায়া মহব্বত থাকাটাই স্বাভাবিক। বড় ছেলে সাজু ভাইসাব দীর্ঘদিন সৌদিআরবে কাটিয়ে এখন সিলেটে এবং ছোট ছেলে বাচ্চুও সৌদি আরবে ছিলো, সেও এখন সিলেটে। মেঝো মেয়ে হেনা আপা আছেন মাধবপুরে। আমরা পাঁচদিনের ছোট বড়। অর্থাৎ তিনি আমার পাঁচদিনের বড়। আমরা ছোটবেলায় জানালা খুলে একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করতাম। তিনি ডাকতেন ‘কা‘ আর আমি ডাকতাম ‘না‘। আমরা একসাথে খেলাধুলা করতাম। সুযোগ পেলেই এক বাড়ি থেকে অন্যবাড়ি ছুটাছুটি করতাম। রেহানা আপার মৃত্যুতে ছোটবেলার অনেক মধুময় কথা মনের মণিকোঠায় দোলা দিচ্ছে।
জানিনা কখন কার ডাক পড়ে। দুলাভাইয়ের জন্যও অনেক কষ্টকর হবে এ শোক সওয়া। তিনি অনেক দিন দুবাই ছিলেন, লন্ডনেও একবার বেরিয়ে গেছেন। তিনি প্রায় সময়ই বলতেন, ‘ফাটা বাঁশের জিন্দেগী‘ রে ভাই। কিন্তু এখন যখন ফাটা বাঁশে জোড়া লাগলো তখন তিনি আপাকে হারালেন। কিন্তু কারো তো কিছু করার নেই। “প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে“ -আল কোরআন। আমাদের একদিন যেতে হবে – এটাই চিরন্তন সত্য। ‘এই পৃথিবী যেমনি আছে, তেমনি ঠিক রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে রে মন, চলে যেতে হবে (বিজয় সরকারের একটি বিখ্যাত মরমী গান)।
আল্লাহতাআলা রেহানা আপাকে মাফ করে দিন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের বাসিন্দা বানান। সাথে সাথে পরিবারের সকল সদস্যদের এই কঠিন সময়ে সবর করার তাওফিক দিন। এই দোআ করি সর্বান্তকরণে।

আকবর হোসেন
টুইকেনহাম, ওয়েষ্ট লন্ডন
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২১
akbargermany92@gmail.com