জামিল খান
শুরুতে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বে আরও এক বিলিয়ন নতুন মুঠোফোনের গ্রাহক তৈরি হবে, যা কিনা মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাকে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়নে নিয়ে যাবে। সম্প্রতি স্পেনের বার্সেলোনায় শেষ হওয়া ‘বিশ্ব মোবাইল কংগ্রেস’-এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এবার যদি আমাদের দেশের দিকে তাকাই, তাহলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বলেছে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে দেশের মুঠোফোন সংযোগের সংখ্যা পৌঁছায় ১২ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজারে। বাংলাদেশের সব কটি মুঠোফোন অপারেটর তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট প্রযুক্তি (থ্রিজি)-সুবিধা দেওয়ায় স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের গণমাধ্যমগুলো তাদের কনটেন্ট পরিষেবা আরও বাড়াতে পারে। চর্চা করতে পারে মোবাইল সাংবাদিকতা।
একজন সাংবাদিক, যিনি স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসির মতো ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রচারের কাজ করে থাকেন, তাঁকেই ‘মোবাইল সাংবাদিক’ বা সংক্ষেপে মোজো বলা হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ জানিয়েছেন, দেশে এখন শুধু স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাই দুই কোটির ওপরে। আর ৩৫ বছরের নিচে তারুণ্যের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। অর্থাৎ স্মার্টফোনের কদর ভবিষ্যতে আরও বাড়তে থাকবে। সাধারণত স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা পছন্দের অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপ দিয়ে ছবি তোলা, ভিডিও বানানো, সামাজিক যোগাযোগের সাইট ভিজিট করা অথবা ইন্টারনেটে দ্রুত বার্তা আদান-প্রদান ও কথা বলার কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া স্মার্টফোনের সাহায্যে আজ গণমাধ্যমের সংবাদ জানার কাজ আগের চেয়ে অনেক সহজতর হয়েছে। তবে স্মার্টফোন এখন আর এসব কাজের মধ্যেই থেমে নেই। অনেক বড় বড় কাজই করা হচ্ছে স্মার্টফোন দিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের নামীদামি গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষে সংবাদ পৌঁছে দিতে স্মার্টফোন নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। এই যেমন বিবিসি তাদের প্রযুক্তিবিষয়ক অনুষ্ঠান ক্লিকসহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পুরোটাই ধারণ ও সম্পাদনার কাজ করেছে স্মার্টফোনের মাধ্যমে। গণমাধ্যমের গতি-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে অনেক উপকারী অ্যাপ। এখন অনেক গণমাধ্যমই তাদের ওয়েবসাইটের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে অ্যাপ বানানো ও এর রক্ষণাবেক্ষণের ওপর।
বাংলাদেশে মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহ কিংবা সম্পাদনার কাজে স্মার্টফোনের ব্যবহার তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে নাগরিক সাংবাদিকদের পাঠানো মোবাইল কনেটন্ট (ইউজার জেনারেটেড কনেটন্ট বা ইউজিসি) ব্যবহারের দিক দিয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে দেশের অনলাইন গণমাধ্যম। আজকাল অবশ্য কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইউজিসি কনেটন্ট প্রচার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আলোচিত দুর্ঘটনার বিশেষ মুহূর্ত মুঠোফোনের ক্যামেরায় ধারণ করেন নাগরিক সাংবাদিকেরা। উদাহরণ হিসেবে পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ লঞ্চডুবি ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। এ দুটি ঘটনারই মুঠোফোন ভিডিও ফুটেজ দেশের প্রায় সব কটি জাতীয় টেলিভিশন ও শীর্ষ অনলাইন পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়।
সাংবাদিকতা পেশায় স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহার এবং এই কাজে ব্যবহারের উপযোগী অ্যাপ ও আনুষঙ্গিক উপকরণের সংখ্যা বাড়তে থাকায় রাশিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে মোবাইল সাংবাদিকতার ওপর কোর্স চালু হয়েছে। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা অনেক সাংবাদিকতা ইনস্টিটিউটে পড়ানো হচ্ছে বিষয়টি। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও সভা-সেমিনার।
মোবাইল সাংবাদিকতার ওপর নিয়মিত গবেষণা ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিও সম্প্রচার সংস্থা আরটিই। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে মোবাইল সিনেমা নির্মাণ, মোবাইল সাংবাদিকতা ও মোবাইল ফটোগ্রাফির ওপর প্রথম আন্তর্জাতিক মোবাইল সাংবাদিকতা সম্মেলন দেশটির রাজধানী ডাবলিনে ২৭-২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করে সুনাম কুড়িয়েছেন—বিশ্বের এমন অনেক সাংবাদিক ও মিডিয়া গবেষক এতে যোগ দেবেন। দুই দিনের এ সম্মেলনে তিনটি সেশন ছাড়াও দুটি কর্মশালার আয়োজন থাকছে। মোবাইল সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আয়ারল্যান্ডের আসন্ন এ সম্মেলনকেই বিশ্বের প্রথম মোবাইল সাংবাদিকতা সম্মেলন বলে জানিয়েছেন। একজন সাংবাদিক স্মার্টফোন ব্যবহার করে কীভাবে হয়ে উঠতে পারেন মোবাইল সাংবাদিক, আর এর জন্য তাঁর করণীয়ই বা কী—এমন খুঁটিনাটি বিষয়ই এ সম্মেলনে আলোচনা করা হবে বলে জানান আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সম্মেলনের উদ্যোক্তা গেলেন মুলচাহি।
বাংলাদেশে মোবাইল সাংবাদিকতা চর্চার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এখনো তা পুরোপুরি বিকাশ লাভ করতে পারেনি। খোদ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা। গণমাধ্যম সংস্থাগুলো মোবাইল সাংবাদিকতার ওপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারে। সাংবাদিকতা পড়ানো হয়—এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বার্তাকক্ষ আর পাঠকের চাহিদার কথা চিন্তা করেই সাংবাদিকতা কোর্সের আধুনিকায়ন করা দরকার। মোবাইল সাংবাদিকতার গুরুত্ব সবার কাছে পৌঁছে দিতে তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম সংস্থাগুলোর সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত।
জামিল খান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ বিভাগ, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া এবং নিউ মিডিয়া বিশেষজ্ঞ।
London Bangla A Force for the community…
