শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিক
ঘটনাটি এখন প্রায় সকলেরই জানা৷ এ মাসের ৩ তারিখ, ঢাকার কাছের সোনারগাঁয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের অবরুদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গটি৷ সেদিন সন্ধ্যায় দেশের প্রায় সবকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইনে এবং পরদিন দৈনিক সংবাদপত্র সমূহ বেশিরভাগই তাদের শিরোনামে লিখেছেন ‘নারীসহ’ মামুনুল হক আটক৷ তার সঙ্গে একজন নারী উপস্থিত ছিলেন, যাকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করেছিলেন মামুনুল৷
পরে এই ঘটনায় যুক্ত হন আরেক নারী যিনি মামুনুলের প্রথম স্ত্রী৷ গণমাধ্যমে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মামুনুলের কথোপকথন ভাইরাল হয়৷ যেখানে মামুনুল স্ত্রীকে পরামর্শ দেন, ‘তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে তুমি বইল যে হ্যাঁ আমি সব জানি৷’ স্বামীর কথা প্রথম স্ত্রী মান্য করেছিলেন কিনা সেটা আমাদের জানা নেই, অমান্য করেছেন এমন কোন খবরও আমরা জানি না৷
এই ঘটনাটিকে সামনে রেখে যদি সমাজে নারীর অবস্থান, তার মর্যাদা ও সম্মানের জায়গাটি আলোচনা করতে চাই, তাহলে বেশ কয়েকটি বিষয় আমাদের সামনে আসে৷
প্রথমে সংবাদ শিরোনামটি ধরেই আলোচনা শুরু করা যাক৷ যেখানে বলা হয়েছে, ‘নারীসহ রিসোর্টে আটক মামুনল’৷ ‘অস্ত্রসহ আটক’ ‘মাদকসহ আটক’ এইধরনের শব্দ-বন্ধ’র পাশে ‘নারীসহ আটক’ শব্দবন্ধটি রেখে দেখুন৷ কি মনে হয়? নারীই এখানে প্রধান সমস্যা, নারীই স্বয়ং অপরাধ৷ মাদক আর অবৈধ অস্ত্রের মতো নারীও একটি বস্তু৷ এবং সত্যিই তাই, সমাজের অনেকের কাছেই নারী এখনো একটি সামগ্রি বা বস্তুর চাইতে বেশি কিছু নয়৷
মামুনুল হকের কথিত দ্বিতীয় বিবাহ ও সামাজিক মনস্তত্ব
মামুনুল হকরা বিভিন্ন সময় তাদের ওয়াজ মাহফিলে সেভাবেই নারীকে উপস্থাপন করেন৷ তারা নারীদের গার্মেন্টসে কাজ করতে যাওয়ার বিরোধিতা করেন, সহ-শিক্ষার বিরোধিতা করেন, নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে উস্কানিমূলক ফতোয়া দেন৷ তাদের কাছে নারী স্বাধীন মানুষ নয় পণ্য, নারী ভোগের বস্তু ৷ তারা নারীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ান৷ নারীর পর্দা নিয়ে বয়ান দেন, নারীকে বাক্সবন্দি করে আটকে রাখতে চান৷ হিজাব, বোরখার বাইরেও নারীর একটা নিজস্ব জীবন থাকতে পারে তা মানতেও তাদের আপত্তি৷ তাদের কাছে নারীর স্বাধীন ইচ্ছা বা মতামতের মূল্য নেই বরং নারীকে তারা নিজেদের হাতের পুতুলের মতো পরিচালনা করতে পছন্দ করেন৷ তাদের সেই ইচ্ছার এক ধরনের বলি হন জান্নাত আরা (যিনি সেদিন মামুনুল হকের সঙ্গে রিসোর্টে গিয়েছিলেন), আরেক ধরনের বলি হন আমেনা তাইয়েবা ( যিনি মামুনুল হকের ‘প্রথম’ স্ত্রী)৷
ইসলাম ধর্মে বহুবিবাহের অনুমোদন আছে এই অজুহাতে এখনো নারীর জন্য চরম অবমাননাকর ও অপমানজনক এই প্রথাটি টিকিয়ে রাখতে তৎপর এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ৷ যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও তৎকালীন আরবের আর্থসামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্ম বহুবিবাহের অনুমোদন দিয়েছিল, সেই আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের পরও বহুবিবাহের পক্ষে সাফাই গান তারা৷
অথচ গবেষণায় দেখা গেছে বহুবিবাহ সব দিক থেকেই নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে৷ যে পরিবারে পুরুষের একাধিক বিয়ের ঘটনা ঘটে সেই পরিবারের স্ত্রী ও সন্তানরা মানসিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকসহ নানারকম দূর্ভোগের শিকার হন৷ আইন অনুযায়ী এক স্ত্রী জীবিত থাকতে আরেক স্ত্রী গ্রহণ করা যায় না৷ তবে বিশেষ প্রয়োজনে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে আরেক বিয়ে করা যেতে পারে৷ কিন্তু পুরুষ প্রধান সমাজে স্ত্রীর মতামত কতখানি গ্রাহ্য করা হয় তা বলাই বাহুল্য৷ আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার দাপট, অর্থের জোর ও অপরিমিত যৌন লালসা পুরুষদের বহুবিবাহের প্রতি উৎসাহিত করে৷ এক্ষেত্রে নারী স্ত্রী হিসেবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ যে অবস্থানেই থাকুন না কেনো তিনি কোনো না কোন ভাবে বঞ্চনার শিকার হন৷ অথচ ধর্মের অপব্যাখ্যা করে কিছু মুসলমান ব্যক্তি সবসময়ই একাধিক বিয়ের সুযোগ নিয়ে থাকেন৷ আরবে প্রচলিত প্রায় দেড় হাজার বছর আগের একটি প্রথাকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করার এই প্রবণতা নারীর জন্য তো বটেই, আধুনিক সমাজের জন্যও ক্ষতিকর৷ যে সমাজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, নারীর মর্যাদা থাকে সেই সমাজে বহুবিবাহ প্রথা আপনা আপনিই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা৷
মামুনুলের ঘটনায় তার প্রথম স্ত্রীর মানসিক অবস্থাটি কেমন হতে পারে তা কি আমরা আন্দাজ করতে পারছি? ফাঁস হওয়া বিভিন্ন ফোনালাপে দেখা যাচ্ছে স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের অন্যান্যরা এখন তাকে ঘটনার পক্ষে সাফাই দিতে বলছেন৷ শিখিয়ে দিচ্ছেন, মামুনুলের কথিত দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে কিভাবে তার উত্তর দিতে হবে৷ সত্যি বলতে কি, সমাজে এ ধরনের ঘটনা আমাদের চোখের সামনে বা অগোচরে হরহামেশাই ঘটছে৷ যেখানে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে বা বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক চরমভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে নারীর জীবন৷ অনেকসময় তাকে সইতে হচ্ছে অবর্ণণীয় শারিরীক মানসিক নির্যাতন৷ কখনো পরিবার ও সমাজের চাপে আবার কখনো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নিরুপায় নারীটি বাধ্য হয় মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করতে৷
আবার মামুনুল কথিত তার দ্বিতীয় স্ত্রীও কিন্তু এই ঘটনায় মিডিয়ার সামনে কম হেনস্থা হননি৷ যে কোন ঘটনার সাথে নারীকে জড়িয়ে তাকে অপদস্থ করার প্রবণতা আমাদের অনেকের মধ্যে আছে৷ আর এখানে তো ঘটনাস্থলেই তাকে পাওয়া গেছে৷ ফলে স্বভাবতই তিনি রসালো ও মুখরোচক আলোচনার পাত্রীতে পরিণত হয়েছেন৷ পরবর্তীতে পুত্রের সাথে জান্নাত আরার কথোপকথনের যে অডিও ফাঁস করা হয়েছে সেখানে এক পর্যায়ে বিপর্যস্ত বিষণ্ন জান্নাত আরাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি কি মানুষ না? আমি কি গরু, গাধা, আমি মরে গেলেই ভাল হইতো? .. আমি কি করবো? মরে যাবো? বলো, আমার সত্যি আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না৷’
সব শেষে আমরা মামুনুল হকের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখতে পাই, তিনি তার দ্বিতীয় বিয়েকে বৈধতা দিতে এটিকে একটি ‘মানবিক বিয়ে’র তকমা দিয়েছেন৷ লিখেছেন, ‘মানবিক ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে আমি তার অভিভাবকত্ব করছি এবং একজন অসহায় নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছি৷’
শেষ পর্যন্ত ‘অসহায়’ জান্নাত আরা হয়তো মামুনুল হককে ‘অভিভাবক’ হিসেবে পাবেন এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সমাজে পরিচিত হবেন৷ কিন্তু নারীর প্রতি সমাজে প্রচলিত যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে মামুনুলের পোষ্টে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পাই৷ যেমন, নারী অসহায়, দুর্বল, পরনির্ভরশীল৷ নারী অধস্তন, অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, নারী নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ৷ নারী একা চলতে অক্ষম, ফলে চলার পথে তার একজন অভিভাবক থাকা বাঞ্ছনীয়৷
নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিই আসলে নারী পুরুষ সমতা ভিত্তিক সমাজ গড়ার পথে প্রধান অন্তরায়৷ নারীকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য না করার কারণেই নারীর প্রতি পুরুষের কর্তৃত্বপূর্ণ ও আধিপত্যবাদি মনোভাব তৈরি হয়৷ তা থেকেই বাড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন৷
অথচ সত্যি হচ্ছে এই যে নারীর অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের লড়াইটা নারীর একার নয়৷ একটি সুস্থ সুন্দর ন্যায়ভিত্তিক পৃথিবী গড়ে তুলতে এটি নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সবার লড়াই৷
সৌজন্যে : কালের কন্ঠ