ব্রেকিং নিউজ
Home / নির্বাচিত কলাম / উকিল বড়ো নাকি ব্যারিস্টার!

উকিল বড়ো নাকি ব্যারিস্টার!

বাংলাদেশের আইন পেশায় ব্যারিস্টারদের অবস্থান

সাকিব রহমান

আমাদের সমাজ ব্যারিস্টারদের ভিন্ন চোখে দেখে। বিশেষ করে আমাদের গ্রামের সাধারণ মানুষরা আদালতের আইনজীবীদের মধ্যে যারা কেবল ‘অ্যাডভোকেট’ তাদের তেমন গুরুত্ব দিতে চান না কিংবা বলা যায় খুব সাধারণ চোখে দেখেন। অন্যদিকে নামের আগে ‘ব্যারিস্টার’ বিশেষণ থাকলেই তার গুরুত্ব ও শ্রদ্ধা অনেকাংশে বেড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে এ দেশের অনেকেই ব্যারিস্টারদের সাধারণ আইনজীবীদের থেকে ‘উঁচু স্তরে’ বিবেচনা করে আসছেন। এর পেছনের বেশ কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম হলো এ অঞ্চলের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার।

বাংলাদেশে একটি ব্রিটিশ বার-এট-ল- ডিগ্রির (ব্যারিস্টারি ডিগ্রি) প্রকৃত মূল্য বা গুরুত্ব ঠিক কতটুকু- এটা জানা সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তি কীভাবে লাইসেন্সধারী আইনজীবী হতে পারেন এ বিষয়েও পাঠকের জ্ঞান কিংবা ধারণা থাকা খুব প্রয়োজন।

অ্যাডভোকেট ও ব্যারিস্টারের মধ্যে পার্থক্য

একজন অ্যাডভোকেট হতে হলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি (এলএলবি) অর্জন করতে হয়। এরপর একজন আইনজীবীর অধীনে ছয় মাস ইন্টার্নি হিসেবে কাজ করতে হয়। এমন আইনজীবীর অধীনে কাজ করতে হবে, যার কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর তিন স্তরের একটি পরীক্ষার জন্য যোগ্য হতে হবে। যেখানে– ১. নৈর্ব্যক্তিক, ২. লিখিত এবং ৩. মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় ধাপ, দ্বিতীয় ধাপে উত্তীর্ণ হলে তৃতীয় ধাপ পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই একজন প্রার্থী পছন্দের জেলা পর্যায়ের নিম্ন আদালতে (প্রতিটি জেলাতেই ১টি করে এ ধরনের আদালত থাকে ) অনুশীলন করার যোগ্য অ্যাডভোকেট হিসেবে অনুমোদিত হবেন।

এখন তাহলে ব্যারিস্টার হবে কারা? বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে অ্যাডভোকেট হওয়া যায় ঠিক এমনই এক পরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে যুক্তরাজ্যে। সেখানে ব্রিটিশ ল’ পড়া শেষ করার পর সেই প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করার সুযোগ পাওয়া যায়। তারা সেখানকার ইংলিশ আদালতে অনুশীলন করতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হয়। এজন্য সেখানের ব্রিটিশ আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরে তাদের বার প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্স (বিপিটিসি) করতে হয়। এরপর যুক্তরাজ্যের আদালতে নিবন্ধনকৃত অনুশীলনকারী একজন পেশাদার ব্যারিস্টারের অধীনে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করার সুযোগ নিতে পারে। ইন্টার্ন হিসেবে ১ বছর পার করতে পারলে সে দেশের আদালতে অনুশীলন করার জন্য একটি অনুমতিপত্রের (প্র্যাকটিসিং সার্টিফিকেট) জন্য আবেদন করতে হয়।

বাংলাদেশের আদালতে দাঁড়িয়ে ব্যারিস্টারগণ

প্রথমত, এটা ঠিক যে বাংলাদেশে ব্যারিস্টারদের অনেকেরই বাংলাদেশি আইন সম্পর্কে জ্ঞান স্বল্প এবং তাদেরও ওই তিন স্তরের পরীক্ষা পর্বটি পার করতে হয়। অর্থাৎ তাদের জন্যও এই অ্যাডভোকেট হওয়াটা বাধ্যতামূলক। ব্যারিস্টার হওয়ার বদৌলতে শুধু ছয় মাসের ওই ইন্টার্নশিপ করার দরকার পড়ে না।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, বাংলাদেশে ব্যারিস্টারদের বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ‘আইনজীবী তালিকাভুক্তি’র পরীক্ষা দেওয়ার দরকার হতো না। সময় এখন বদলেছে। বাংলাদেশে আইন পেশায় থাকতে হলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষায় সবাইকে বসতে হবে। অর্থাৎ যে বাংলাদেশে স্নাতক শেষ করুন অথবা যুক্তরাজ্য থেকে বার-এট-ল’ শেষ করে আসুন, সবাইকে এই পরীক্ষা দিতে হবে। তার মানে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নিয়ে এলে পরীক্ষায় আলাদা ছাড় পাওয়ার কোনও সুযোগ এখানে নেই। কাজের ক্ষেত্রে অবশ্য উচ্চ আদালতে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে যেখানে একজন আইনজীবীর নিম্ন আদালতে ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার দরকার হয় সেখানে কারও ব্যারিস্টারি ডিগ্রি থাকলে ১ বছরের অভিজ্ঞতাতেই হয়ে যায়। এই এক বছরের সুবিধাটা স্বীকৃত কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে একটি মাস্টার্স ডিগ্রি (এলএলএম) থাকলেও পাওয়া যায়

বাংলাদেশি ব্যারিস্টাররা কি যুক্তরাজ্যে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারেন?

পাঠকদের একটি ধারণা দেওয়ার ছিল যে ব্যারিস্টারদের (শুধু বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা) অবস্থান ও বাংলাদেশের অন্যান্য উকিলদের (‘যারা ব্যারিস্টার নন’) অবস্থান সমান।

আমার মূল বক্তব্যটি হলো বাংলাদেশে যাদের নিজেকে ব্যারিস্টার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তারা কি যুক্তরাজ্যের আদালতে আদৌ আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারেন?

আমি ইতোমধ্যে বলেছি, যেকোনও ব্যারিস্টারকে যুক্তরাজ্যের আদালতে নিবন্ধনকৃত একজন পেশাদার ব্যারিস্টারের অধীনে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতে হয়। কিন্তু অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ব্রিটিশ আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরে বার প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্স (বিপিটিসি) শেষে একজন পেশাদার ব্যারিস্টারের অধীনে ইন্টার্নশিপ ঠিকমতো শেষ করতে পারে না। কারণ হলো সেখানকার ল’ চেম্বারগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক কাজের চাপ অত্যন্ত বেশি। আর ওই অনুমতিপত্রের (প্র্যাকটিসিং সার্টিফিকেট) জন্যে আবেদন করাটা তাদের অনেকের জন্যে অধরাই রয়ে যায়। এখন ইন্টার্নশিপ শেষ করতে না পারলে এবং অনুমতিপত্র বা প্র্যাকটিসিং সার্টিফিকেট পেতে ব্যর্থ হলে ব্রিটেনের বার স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড অনুসারে তাদের বলা হয় ‘অনিবন্ধিত ব্যারিস্টার’।

বাংলাদেশের অনেক ব্যারিস্টার অনিবন্ধিত এবং এভাবে তাদের আইনজীবী হিসেবে সেদেশে কাজ করার কোনও অনুমতিপত্রও নেই। যুক্তরাজ্যের ‘ব্যারিস্টার’ বিষয়ক বিধিগুলো স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, অনুমতিপত্র ব্যতীত ব্যারিস্টার পরিচয় দিয়ে যেকোনও ধরনের আইনি সেবা প্রদানসহ সকল প্রকার মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা, নোটারিয়াল পরিষেবা প্রদান, শপথ গ্রহণ ইত্যাদি করা হলো ফৌজদারি (দণ্ডমূলক) অপরাধ।

এটি সত্য যে, যেহেতু বিধিনিষেধগুলো কেবল যুক্তরাজ্যের সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ; আইনে তো বলা নেই দেশের বাইরেও তারা ব্যারিস্টার পরিচয় দিতে পারবেন না। তাই যুক্তরাজ্যের অনিবন্ধিত ব্যারিস্টাররা আবার বাংলাদেশে লিগ্যাল কাজ করতে পারেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে অনিবন্ধিত ব্যারিস্টারদের জনসম্মুখে ‘ব্যারিস্টার’ হিসেবে উল্লেখ করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এমনকি তারা এই ‘ব্যারিস্টার’ বিশেষণটি তাদের কোনও কার্ড বা ছাপানো নাম-ঠিকানাতেও ব্যবহার করতে পারেন না। কিন্তু আইনি পেশা ছাড়া অন্য যেকোনও পেশায় তারা ব্যারিস্টার বিশেষণ ব্যবহার করতে পারবেন। সে সুযোগটি রয়েছে।

তবু আমাদের দেশে এসে অনিবন্ধিত ব্যারিস্টারদের অনেকেই ‘ব্যারিস্টার’ বিশেষণটি হরহামেশাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তাদের পক্ষের দেখানো যুক্তিটি হলো– বাংলাদেশে থেকে তো ব্যারিস্টার হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তাকে ব্রিটেন থেকেই ডিগ্রিটি আনতে হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনও বিধিনিষেধও নেই। তাই আইনি সেবা দিতে তাদের কোনও বাধা নেই। একইসঙ্গে এটা বেআইনিও নয়। কারণ, তারা তো বার কাউন্সিল পরীক্ষা দিয়েই আইনি সেবা দেওয়ার কাজ করছেন।

‘বার-এট-ল’ ডিগ্রিটি এখনও বাংলাদেশে হটকেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। কারণ, বেশিরভাগ মানুষের এ সম্পর্কে ধারণা কম। তারা অ্যাডভোকেট থেকে ব্যারিস্টারদের বেশি প্রাধান্য দেন। মূল কারণটি সম্ভবত তারা ভাবেন যে বাংলাদেশের এসব ব্যারিস্টাররা যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও আইনি সেবা দিতে সক্ষম। অনেকে যে দেন না তা নয়। অনেকেরই দেশে ও যুক্তরাজ্যে দুই জায়গাতেই চেম্বার রয়েছে।

এই লেখার মূল বার্তাটি সেসব পাঠকের জন্যে যারা ইতোমধ্যে আইনজীবী হয়েছেন বা ভবিষ্যতে আইনজীবী হতে চাচ্ছেন। কিংবা তাদের জন্য যারা সব বিষয়ে খোঁজ-খবর না নিয়েই ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্নে লাখ লাখ টাকা খরচ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন।

একটি যুক্তি সম্ভবত সঠিক যে, ব্যারিস্টারদের ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা থাকে। যেহেতু তারা ব্রিটিশ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাই তাদের ইংরেজিতে দক্ষতা ভালো– এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এটাও সত্য যে, তাদের করা বিপিটিসি কোর্সটি আইনি খসড়া, চুক্তির কাগজ তৈরি, দক্ষতা, ক্লায়েন্ট ব্যবস্থাপনা এবং শুনানির দক্ষতাকে আরও পাকাপোক্ত করে। এ জায়গাগুলোতেই অবশ্যই তারা এগিয়ে থাকেন।

সে যাই হোক, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত বা নকশাকৃত এ জাতীয় কোর্সটি বিপিটিসি থেকেও অধিক কার্যকর এসব ক্ষেত্রে। কারণ হলো, ব্রিটিশদের মামলা মোকদ্দমার সঙ্গে আমাদের মামলা মোকদ্দমার প্রথাগত ভিন্নতা রয়েছে এবং ওই বিপিটিসি থেকে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রায়োগিক ক্ষেত্রও বাংলাদেশে সে অর্থে নেই।

তাই আমার অভিমত হলো, কোনও আইনের স্নাতক যদি বাংলাদেশে আইন পেশা অনুশীলন করার পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে তার জন্যে বাইরের দেশ থেকে একটি ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নেওয়ার চেয়ে সেখানের কোনও সুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষায়িত এলএলএম-এর (মাস্টার্স অফ ল) একটি ডিগ্রি নেওয়ার পেছনে বিনিয়োগ করাটা অধিক কার্যকর ও যুক্তিসঙ্গত হবে।

বাংলাদেশে এই ব্যারিস্টারি ডিগ্রির কোনও শিক্ষাগত এবং পেশাগত মূল্য নেই, যেখানে একটি বিশেষায়িত এলএলএম ডিগ্রির মূল্য রয়েছে।

লেখক: আইনজীবী, ঢাকা জেলা জজ আদালত ও জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, আইন বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়