আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিদ্যার শিক্ষার্থীদের গলদঘর্ম হতে দেখে আমাদের দেশের বস্তুবাদী চিন্তাবিদরা বহুকাল আগেই এর একটি দেশজ সংস্করণ বের করে গেছেন, পাঠক এ কথা জানেন কি? জানেন না, না? জানবেন কী করে! এটাই তো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যদশার প্রমাণ। যে বিষয়টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উঠতে-বসতে, আপদে-বিপদে, সুখে-দুঃখে সব সময় কাজে লাগছে, যার ব্যবহার ছাড়া আমাদের জীবন অচল, দেখুন তো দেখি, সেই থিওরি অব রিলেটিভিটি : বাংলাদেশ সংস্করণ বা বাংলাদেশ স্টাইল-ই কি না আমাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত নেই!
আগে শুধু ভাগ্নেরা খুঁজে খুঁজে বের করত মামুদের, এখন দিনকাল পাল্টেছে। জাতি গঠনে উদগ্রীব মামুরা দেখছেন, ভাগ্নেরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। তাঁরা যে তাদের সময়মতো সাহায্য-সহযোগিতা করবেন সে সুযোগটাও মামুদের জন্য তারা তৈরি করতে পারছে না। তাঁরা তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ময়দানে নেমে পড়েছেন। কোনো রকম রাখঢাক না করে তরিকা বাতলে দিচ্ছেন ভাগ্নেরা কিভাবে কতটুকু এগোলে বাকিটুকু তাঁরাই সামাল দেবেন। ভাবটা এ রকম, যেন মাঝি বলছে যাত্রীদের : তোমরা কোনোমতে নৌকাতে ওঠো তো বাপু, ওপারে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। সম্প্রতি এক বড় মামু এ ব্যাপারে একেবারে ঝেড়ে কেশেছেন : তোমরা কোনোমতে লিখিত পরীক্ষাটা পাস করো, পরবর্তী পর্যায়ে মৌখিক পরীক্ষা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির জন্য নো চিন্তা, ডু ফুর্তি, আমরা আছি। এ রকম বরাভয় পাওয়ার পরও কোনো অকালকুষ্মাণ্ড ভাগ্নে যদি বিসিএস বা এ ধরনের কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বৈতরণী পার হতে না পারে, তবে তাকে দল থেকে, না না দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত। এ ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না- দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে না, গণতন্ত্রের বিকাশ হবে না, গণতন্ত্রের প্রথম সোপান যে সাধারণ নির্বাচন, তাতেও একজন দেশপ্রেমিক, নিরপেক্ষ, কর্তব্যপরায়ণ ও আপাদমস্তক সৎ সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমাদের দলের জন্য ‘বুক পেতে’ দেবে না। তার দক্ষ পরিচালনায় ভোটকেন্দ্রগুলো দখল করা, ব্যালট পেপারে সিল মারা, বিশেষ বিশেষ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে না দেওয়া ইত্যাদি দায়িত্ব পালন মোটেই সম্ভব হবে না। হবে কী করে? সে তো মামু কে, মামুর ভূমিকা কী তাই জানে না।
থিওরি অব রিলেটিভিটি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
২.
এখানে পাঠকের কাছে একটা বিষয় খোলাসা করা দরকার। এতক্ষণ আমরা থিওরি অব রিলেটিভিটি- যার দেশজ সংস্করণের নামকরণ হতে পারে ‘মামাতত্ত্ব’- সম্পর্কে আলোচনার অবতারণা করতে গিয়ে শুধু মামা-মামা করছি। মনে হতে পারে যেন চাচা, ফুপা, খালু, দাদা, দুলাভাই গংদের বাদ দিয়ে শুধু মামার ধামা ধরছি আমরা। তেমনি আমরা যখন বলি, ‘শুধু আমি আর মামু, ভাগ করি খামু’ তখনো ভাগ-বাটোয়ারা থেকে অন্য সবাইকে মনে হয় যেন বাদ দিচ্ছি। আসলে রিলেটিভিটি থিওরিতে অর্থাৎ মামাতত্ত্বে মামা বা মামু একটি প্রতীকী শব্দ। ফলে আমাদের একটা বহুল উচ্চারিত প্রবাদ বাক্য ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ শুধু মামাকেই বোঝায় না, থিওরি অব রিলেটিভিটির আওতায় আসলে আত্মীয়-অনাত্মীয়- রিলেটিভ-ননরিলেটিভ (লক্ষ করে দেখুন, নন শব্দাংশটিকে রিলেটিভের পরে নিয়ে এলে খাপে খাপে মিলে গিয়ে ইংরেজিমিশ্রিত বাংলা হয়ে যায় ‘রিলেটিভ নন’, অর্থাৎ আত্মীয় নন। কাকতালীয় হলেও ব্যাপারটা বেশ মজার) সবাই এসে যায়। যার কাছ থেকে উপকার পাওয়া যায়, ঠেকায়-অঠেকায় যার কাছে গিয়ে সাহায্যের হাত পাতা যায়, যার সামর্থ্য আছে সাহায্য করার, তিনিই এই থিওরির আওতায় ‘মামা’ বা ‘মামু’। তাঁর সঙ্গে সাহায্যপ্রত্যাশীর কোনো রক্তের সম্পর্ক তো দূরের কথা, এমনকি আলাপ-পরিচয়ও না থাকতে পারে, তিনি পাড়াতুতো-গ্রামতুতো মামা-চাচা-খালু কিংবা সর্বজনস্বীকৃত অমুক ভাই-তমুক ভাই হলেও হতে পারেন, না হলেও ক্ষতি নেই, তাঁর সাহায্য করার ক্ষমতা থাকলেই হলো। তিনি নিজে ক্ষমতাধর হতে পারেন, হলে ভালোই, না হলে ক্ষমতার বলয়ের কাছাকাছি থাকলেই চলবে। এক কথায় যাঁকে ধরলে কাজ হয় তিনিই মামা বা মামু। নিজের মামাই হোক আর পরের মামাই হোক। রিলেটিভ না হয়েও তিনি রিলেটিভ। কাজ হাসিলের জন্য তিনি শুধু আত্মীয় নন- পরমাত্মীয়। থিওরি অব রিলেটিভিটি বা মামাতত্ত্বের মামা, আমাদের কিংবদন্তির মামা, যাঁর নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে জোর শব্দটি, তিনি যে কত কাজের লোক, তিনি কানা হোন আর খোঁড়া হোন, তাঁর অস্তিত্ব যে কত অপরিহার্য, তা বঙ্গদেশীয়রা আবহমানকাল ধরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে আসছেন।
৩.
মামাদের কারণে মামাহীনদের ভাগ্যবিপর্যয় নতুন কিছু নয়। এটা চলে আসছে সেই ব্রিটিশ আমল বা তারও আগে থেকে। অনেক যোগ্য প্রার্থীকে ডিঙিয়ে মামারা ভাগ্নেদের চাকরি-বাকরি, জমি-জিরাত, মনসবদারি-তহশিলদারি বাগিয়ে দিতেন। মামারা ছিলেন বাগিয়ে দেওয়া বাগাওতউল্লা, আর ভাগ্নেরা পানেওলা পানাউল্লা। তবে এসব বাঁকা পথে সুবিধা আদায় বা খেলাত বণ্টন ছিল সীমিত আকারে। বাদশাহী আমলে বোধগম্য কারণেই সুবিধা প্রদানে কোনো নিয়মনীতির বালাই ছিল না। বাদশাহ নামদার বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারী ইচ্ছামতো যাকে খুশি তাকে যা খুশি তাই দান করতে পারতেন। তা সুবেহদারি-মনসবদারি বা চাকরি-বাকরি, খেতাব-খেলাত যাই হোক না কেন। ইংরেজদের প্রথম আমল অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি আমলও (১৭৫৭-১৮৫৮) মোটামুটি এভাবেই চলে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ (১৮৫৮) করার পর জনপ্রশাসন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে আইনকানুন ও বিধিবিধানের প্রবর্তন করে। ফলে যোগ্যতার ভিত্তিতে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি নির্ধারিত হতে থাকে। কিংবদন্তির মামুজির ভূমিকা তখন পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি খর্ব হয়ে যায়। সার্বিক শাসনব্যবস্থায় খেয়ালখুশিপনার স্থলে প্রবর্তিত হয় ডিসিপ্লিন। যে লৌহশাসন ও সিভিল সার্ভিসের ‘স্টিল ফ্রেমের’ জোরে ইংরেজরা এই ভূখণ্ডে দোর্দণ্ড প্রতাপে ২০০ বছর রাজত্ব করতে সক্ষম হয়েছিল, তার মূলে ছিল আইনের শাসন, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার। তাদের লেখা আইনের বইগুলোতে প্রথমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কেটে পাকিস্তান ও পরে, ১৯৭১ সালের পর, পাকিস্তান কেটে আমরা বাংলাদেশ বসিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের তেমন কিছু ইতরবিশেষ সংযোজন-বিয়োজন করতে হয়নি। ব্রিটিশদের প্রণীত ও প্রচলিত আইনকানুনগুলোকে আমরা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে উপযোগী বলেই গ্রহণ করেছি। এতে দোষের কিছু নেই। ঔপনিবেশিক কবলমুক্ত সব দেশই তাই করেছে।
৪.
কিন্তু সর্বনাশটা হলো ওইসব আইনের প্রয়োগের বেলায়। আমরা মুখে সাম্যের কথা, ন্যায়নীতির কথা, আইন সবার জন্য সমান, কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়- এসব কথা তারস্বরে হরহামেশা বলতে বলতে গলা ফাটালেও প্রয়োগের বেলা লবডঙ্কা। নইমুদ্দির গোয়ালের গরু চুরি হয়ে গেছে, নইমুদ্দি থানায় গেল এজাহার দিতে। সারা দিন সেখানে বসে থেকে সন্ধ্যায় বিফল হয়ে মুখটা ব্যাজার করে ফিরে আসতে হলো বেচারাকে। কেন? সে আগে চেয়ারম্যান সাহেবকে জানায়নি বলে ঘটনা যে সত্যি, তা দারোগা সাহেব মানতে নারাজ। পরদিন অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের এক চ্যাংড়া মাতবরকে ধরে, দারোগার হাতে কিছু গুঁজে দিয়ে ‘কেস’ নেওয়াতে সক্ষম হয় নইমুদ্দি। এখানে ওই চ্যাঙ্গট নেতা আর সর্বরোগের মহৌষধ মালপানি হচ্ছে হাল আমলের মামু।
ওইদিনই এমপি সাহেবের মুরগি চুরির কথিত অপরাধে তিনজন বেকার যুবককে থানায় এনে রামধোলাই দেওয়া হলো। ওরাই মুরগি চুরি করেছে মনে করার কারণ হলো, এমপি সাহেবের ইলেকশনের সময় ওরা কাজ করেছিল বিরোধী প্রার্থীর পক্ষে।
পাড়ার মনু মিয়া মাস্টারের ছেলেটা সেই ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় খুবই তেজি, কখনো ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি পরীক্ষায়। জিপিএ ৫, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ইত্যাদির ওপরেও কিছু থাকলে নিঃসন্দেহে সেগুলোও পেত ছেলেটি। পাসটাস করে সে ইন্টারভিউ দিল ব্যাংকের চাকরির জন্য। পদ একটাই। দুর্ভাগ্য, সে চাকরিটা পেল না। কারণ তার মামুর জোর ছিল না। পেল কে? পেল পাশের বাড়ির কন্ট্রাক্টর সাহেবের ছেলে, যে রেজাল্টের দিক দিয়ে কখনো শিক্ষকপুত্রের ত্রিসীমানায়ও পৌঁছাতে পারেনি। এখানেও মামু। এই ছেলের বড়লোক বাবার সঙ্গে খাতির ব্যাংকের এক ডাইরেক্টর সাহেবের। রিলেটিভিটি থিওরির এ ধরনের হাজার হাজার উদাহরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের চারপাশে।
বাংলাদেশের অফিস-আদালতে কোনো কিছুর জন্য পারমিশন বা অনাপত্তি চাইতে গেলে শুরুতেই শুনতে হবে ‘না’। তা আপনার ‘কেসটি’ যতই নির্ভেজাল ও সঠিক হোক না কেন। আবার সকালবেলার ওই ‘না’-ই দুপুরে একটা টেলিফোন কলের পর অথবা টেবিলের তলা দিয়ে একটি খাম ধরিয়ে দেওয়ার পর এক মিনিটে হয়ে যাবে ‘হ্যাঁ’। অবশ্য ‘সঠিক খালের ভেতর দিয়ে’ না গেলে প্রথমে আপনাকে না শুনতেই হবে, যদি আপনি কেউকেটা কেউ না হন। ‘সঠিক খাল’ মানে বুঝলেন না? ওটা ইংরেজি ‘থ্রু প্রপার চ্যানেল’ কথাটির ‘সঠিক’ বঙ্গানুবাদ। স্বাধীনতার পর অফিস-আদালতে যখন বাংলায় নোট লেখার হিড়িক পড়ে গেল তখন একজন কেরানি সাহেব নাকি নথিতে ইংরেজি বাক্যাংশটির এরূপ অনুবাদ করেছিলেন। এটা অবশ্য আমার শোনা কথা। সত্য-মিথ্যা জানি না। তা আলেচ্য ক্ষেত্রে সঠিক খাল হচ্ছে ওই মামু। আর রিলেটিভও সেই মামু এবং/অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের টাঁকশাল থেকে ছাপানো কিছু বিশেষ কাগজভর্তি একটি খাম। এই রিলেটিভদের ক্যারিশমা মুহূর্তে জাদুর মতো কাজ করে।
পরিচয়, সম্পর্ক, সুপারিশ, তদবির- এসব ছাড়া বাংলাদেশে বেঁচে থাকা দায়। স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করানো, অফিসে পিয়ন-চাপরাশির চাকরি থেকে শুরু করে ছোট পদ-বড় পদ, পদোন্নতি, বদলি, সবখানেই সুপারিশ, সবখানেই তদবির। আজকাল একটি পিয়নের চাকরি পেতেও নাকি লাগে চার-পাঁচ লাখ টাকা, আর না হয় কড়া ডোজের তদবির। আর শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করতে গেলে যে কি পরিমাণ তদবির- বোথ ইন ক্যাশ অ্যান্ড কাইন্ড লাগে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তো এই কারণে আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতেই চান না।
পরিচয় নেই তো যত প্রয়োজনই হোক না কেন দেখা মিলবে না স্যারের। এক লোক গেছে এক অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি অফিসের কাজকর্ম ফেলে টেবিলের ওপর পা তুলে টিভিতে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন। ওই দর্শনার্থী ‘আসব স্যার?’ বলেই পর্দা ঠেলে ঢুকে পড়তে স্যার রেগেমেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। ‘দেখছেন না কাজে ব্যস্ত আছি? বিনা পারমিশনে ঢুকে পড়লেন কেন? অফিস ডিসিপ্লিন-টিসিপ্লিন কিছুই জানেন না দেখছি।’ ওই লোকের আবার গায়ের রং ছিল কাক্কেশ্বর কুচকুচে। বড় সাহেব তাকে টিটকারি মেরে বললেন, তা ক্রিকেটের মাঠ ছেড়ে এখানে কি মনে করে জনাব হ্যামিল্টন মাসাকাদজা? জিম্বাবুয়ে দলের একজন ঘোর কৃষ্ণকায় খেলোয়াড়ের গাত্রবর্ণের সঙ্গে তার গাত্রবর্ণের মিলের কারণে যে খোঁচাটি দিলেন বড় সাহেব, তা নীরবে হজম করে লোকটি বলল, স্যার, আমাকে এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন। আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলেন না…। সঙ্গে সঙ্গে স্যারের মেজাজ স্ফুটনাঙ্ক থেকে এক লাফে হিমাঙ্কের নিচে। ‘আরে, তা আগে কইবেন তো। দেখো তো দেখি, আমি ভাবলাম এই অসময়ে কে না কে…।’ ইত্যাদি।
যেকোনো জায়গায়- বাসের লাইনে, ব্যাংকের কাউন্টারে, ট্রেনের টিকিট কিনতে- আপনাকে শেষে গিয়েও লাইনের পেছনে দাঁড়াতে হবে না, আপনি সর-সর করে চলে যাবেন লাইনের আগায়, যদি আপনি মোটামুটি বড়সড় কেউও হন। আর আপনার ডাকসাইটে পরিচয়টা যদি আপনার বেশভূষা-হম্বিতম্বি থেকে ওখানকার কর্তাব্যক্তিটি বা কাউন্টারের ওপাশের কর্মচারী একবার পেয়ে যান, তাহলে তো পরবর্তী দৃশ্যে নির্ঘাত দেখা যাবে আপনি ওই কুঠুরির ভেতর ফ্যান অথবা এসির আরাম উপভোগ করছেন চা কিংবা শীতল পানীয় সেবা করতে করতে। আর আপনার কাজটি করে দেওয়ার জন্য বড় কর্তা-ছোট কর্তা-পিয়ন-চাপরাশি সবার হুটোপুটি লেগে যাবে। এখানে রিলেটিভিটি হচ্ছে আপনার সামাজিক অবস্থান বা আপনার পদ, আপনার পরিচয়। ওটা হচ্ছে বাংলাদেশে যেকোনো আইন ভঙ্গ করার লাইসেন্স। তা ট্রাফিক লাইট অমান্য করাই হোক বা যেকোনো অফিস-আদালত-হাসপাতালে ‘দেখি সরেন’ বলে দ্বাররক্ষীকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে ঢুকে পড়াই হোক। এসব ক্ষেত্রে ভাবটা এই : লালবাতিতে গাড়ি যাবে না, বিনা অনুমতিতে কারো অফিসে ঢোকা যাবে না, ডাক্তার রোগী দেখার সময় তার চেম্বারের ভেতর যাওয়া যাবে না- এসব নিয়মকানুন তো আমার জন্য নয়, পাবলিকের জন্য। আমাকেও কি পাবলিক মনে করেন নাকি? এ ধরনের সিচুয়েশনে যে কথাটি প্রায়শই উচ্চারিত হতে শোনা যায় তা হচ্ছে : জানেন, আমি কে?
না, আপনাকে পাবলিক মনে করি না, তাহলে আপনি কে? আপনি আজরাইল ফেরেশতা, না মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামাও তো তাঁর নিজ দেশে আইন না মানলে ওই ট্রাফিক পুলিশ তাঁর প্রেস্টিজ পাংচার করতে এক মুহূর্ত দেরি করে না।
আসলে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে যে ‘এলিটিজম’ বা অভিজাততন্ত্রের জন্ম হয়েছিল, এত রক্তের সাগর পেরিয়ে এসেও দেশ তা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এর কারণ, দেশে সাম্য নেই, সম-অধিকার নেই, আইন সবার ওপর সমানভাবে প্রয়োগ করা হয় না। জালিয়াতিতে এক পাল বড় কর্তা ধরা পড়লে, কোনো হোমরা-চোমরার আত্মীয় সাত খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলে, কোনো মন্ত্রী-ফন্ত্রী কোনো গণবিরোধী কথা বললে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় কী করে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের রক্ষা করা যায়। অথচ একজন সাধারণ মানুষ এ ধরনের অপরাধ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে জালিয়াত, খুনি, দেশদ্রোহী ইত্যাদি খেতাব দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে বাঁশডলা দেওয়া হয়। বিচারের মানদণ্ডের এই যে হেরফের, এতে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় চরম হতাশা ও দেশের শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির প্রতি সীমাহীন আস্থাহীনতা। এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না।
৬.
এর চেয়ে বরং একটা কাজ করলে কেমন হয়! আসুন, আমরা দেশে দুই ধরনের আইন চালু করি। যারা সমাজের ওপরের তলার মানুষ- যেমন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশীমানব, অগাধ সম্পদের মালিক, ইয়া বড় আমলা, একগাদা সন্ত্রাসীর পোষক- তাদের জন্য এক আইন। আর বাদবাকি আমজনতার জন্য আরেক আইন। প্রথম ক্যাটাগরির হুজুরদের বিচারব্যবস্থা, আদালত, কারাগার সবই হবে ভিআইপি মানের, আর বাকি পাবলিক এখন যেমন আছে, তেমন থাকলেই চলবে। এই দ্বিমুখী ব্যবস্থা চালু হলে আর কারো কোনো আপত্তি থাকবে না, থাকবে না কোনো চিত্তজ্বালা (হার্টবার্নিং)। তখন রেলের টিকিটের লাইন দেড় মাইল লম্বা হলেও ফার্স্ট ক্যাটাগরির অর্থাৎ ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন অথবা তাঁর লোক গটগট করে স্টেশন মাস্টারের কামরায় ঢুকে এক মুহূর্তে কাজ শেষ করে হেলতে-দুলতে বেরিয়ে আসবেন। ডাক্তার সাহেব অপারেশন থিয়েটারে যত জটিল অপারেশনে ব্যস্ত থাকুন না কেন, ওই স্যার দরজা ঠেলে ঢুকে বলতে পারবেন, ডাক্তার সাহেব, আমার প্রেসারটা একটু মেপে দিন তো। আমি একটা মিটিংয়ে যাচ্ছি। অলরেডি লেট হয়ে গেছে। জলদি করুন।
এ ধরনের সিস্টেম চালু হলে সবাই চেষ্টা করবে ‘ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন’ হতে। তাতে লেখাপড়া লাগুক আর না লাগুক। বরং না লাগার সম্ভাবনাই বেশি। এখন যাঁরা ‘রিলেটিভ’ আছেন তাঁদের পোঁ ধরলেই হলো, পোঁ ধরতে ধরতে দেখা যাবে একদিন নিজেরাও সেকেন্ড ক্লাস থেকে ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেনে প্রমোশন পেয়ে গেছেন। তাঁদের মেধায় ও শ্রমে দেশ নিশ্চয়ই উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে!
৭.
সেই ১৯৮৮ সালে এ বিষয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম। প্রাসঙ্গিক হবে মনে করে আজকের লেখাটার ইতি টানছি সেই কবিতাটি দিয়ে। কবিতাটির নাম ‘বাছ-বিচার’। কবিতাটি এ রকম : ‘কেডা রে? ওইখান দিয়া যায়/এইডা কেডা?’ ‘আমি, আমি চেয়ারম্যানের বেডা।’/ ‘ও …বাজান?/ তা আহেন না এট্টু বইয়া যান/ওই হালারা খাড়াইয়া দেখতাছস কী/ লণ্ঠনটা আন।’/ ‘কেডা রে? আবার কেডা আইলি?’/’হুজুর আমি কদমালি’/’কী কইলি? কদমালি?/ওরে আমার সোনারচান পিতলাঘুঘু/তা এইদিকে ঢুঢু/মারতাছো ক্যারে?/রাইতে-বিরাইতে নাই বুঝি আর কাম?/আবে হালায়, ভাগলি? না আমি আইতাম?’
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com.
London Bangla A Force for the community…
