সংযম ভুলে অসহিষ্ণু ওয়াজ ও হুঙ্কার কি সভ্যতার পরিচায়ক?
ধর্মনিরপক্ষ দেশে ধর্ম নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি দেখে রীতিমতো আক্কেল গুড়ুম। তার উপর আবার ধর্মনিরপেক্ষবাদী রাজনীতিকরাও জড়িত। শেষ পর্যন্ত এই দেশ থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতারও জলাঞ্জলি…!
একই ধর্মের ভিন্ন মতাবলম্বীদের যারা সহ্য করতে পারেন না তারা যে অন্য ধর্মালম্বী বা ধর্মহীন মানুষকে সুযোগ পেলে ছেড়ে কথা বলবেন না, তা সহজেই অনুমেয়। রামাদ্বানের মাসে সিলেটে এই মারমুখী আন্দোলন দেখে ভাবছি- আমাদের আলেমরা এই মাসে মানুষকে সংযম শিক্ষার নসিহত করেন। কিন্তু তাদের কি সেটির আমল করার প্রয়োজন নেই?
ইসলামের প্রাক যুগ থেকে বিভিন্ন মাযহাব তথা নানা পথ ও মত আভির্ভূত হয়ে আসছে। বরং বিভিন্ন আ’মলি বিষয়ে ইখতেলাফ বা মতানৈক্যকে ইসলাম উৎসাহীত করে থাকে। তাছাড়া খতমে নবুয়ত থাকলেও খতমে মাযহাব আছে বলেতো জানা নেই। পৃথিবীতে নানা মত ও পথ আসতেই থাকবে, মানুষ তা যাছাই করে গ্রহণ করবে বা বর্জন করবে – সেই এখতিয়ার আল্লাহ তা’আলাও দিয়েছেন।
সিলেটে সাম্প্রতিক যে বিষয়গুলো নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং এটিকে কেন্দ্র করে যে উত্তাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে তাও মাযহাব বা তরিকা সম্পর্কিত। অর্থাৎ তারাবিহ আট রাকা’আত না বিশ রাকা’আত পড়তে হবে। উভয় মতের পক্ষে হাদিস রয়েছে- এটা অনেক আলেমও স্বীকার করে থাকেন। কিন্তু এর ব্যাখ্যা বিভিন্নজন ভিন্নভাবে করে আ’মল করছেন। যার কাছে যেটি উত্তম মনে হয় তিনি তা পালন করবেন সেটিইতো স্বাভাবিক। এখানে জোরজবরদস্তির কি আছে? তাছাড়া বিষয়টি আ’মলি, ঈমান সংক্রান্ত নয়। আর ঈমান সংক্রান্ত হলেও কারো প্রতি শক্তি প্রদর্শন নয়, বড়জোড় নসিহত করা যেতে পারে। সিলেটে ইসলাম রক্ষার নামে জোট বেঁধে যা করা হচ্ছে তা মোটেও শোভন নয় – অন্তত এই গ্লোবালবিশ্বের জামানায়। কারণ সারা বিশ্বে বিভিন্ন তরিকায় ইসলামের চর্চা হচ্ছে এবং কেউ কাউকে বাঁধা দেয়া দূরে থাক, বাঁকা দৃষ্টিতেও তাকাচ্ছে না। মারাত্মক কোনো ভুল হলে আস্তে করে সংশোধন করে দেয়ার শিক্ষা দেয়ার বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত। আর এটাই ইসলামের শিক্ষা, ভ্রাতৃত্বের অনুপম উদাহরণ।
ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়-আশয় ঠিক রেখে বিভিন্নভাবে ধর্ম চর্চা করে আসছেন বিশ্বের মুসলমানরা। যা আমরা মাল্টি-কালচারাল বৃটেনে বহুদিন থেকে দেখে আসছি। এমনকি মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র মক্কা মুকাররামায়ও বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলমানরা স্ব স্ব দেশে অভ্যস্ত নিয়মেই ধর্মীয় আচার পালন করেন, তা চার মাজহাবের কোনো একটির অনুসরণে অথবা অন্যভাবেও করতে দেখা যায়। কই, কেউতো তাতে বাঁধা দিতে দেখি না। বাংলাদেশে একটু হেরফের তথা প্রচলিত ধারার বিপরীত কিছু দেখলেই আলেমদের মাথা গরম হয়ে যায়। যে কোনভাবে সবাইকে চার মাযহাবের ভেতরে থাকতেই হবে বলে বদ্ধমূল ধারনা তাদের। কেউ তা না মানলে “লা-মাযহাবী” লেবেল দিয়ে তাদের ইসলাম থেকে খারিজ করতেও তারা খুব তৎপর। অথচ সেই তারাই সব মাযহাবকে সমান মর্যাদা দেন না। দেখা যায়, তারা অন্য মাযহাবের নিজেদের হানাফী বা আহনাফ হিসেবে বেশী মর্যাদাবান মনে করে আপ্লুত হন।
জ্ঞানার্জনের গুরুত্বের কমন একটি হাদিস আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে, শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীন দেশে যাও। কিন্তু অত্যধিক মাযহাব প্রেম দেখে মনে হচ্ছে হাদিসটি হওয়া উচিত ছিলো- জ্ঞান অর্জনে আবু হানিফা কিংবা শাফ’ঈ গং (রহ.) দের পর্যন্ত যাও। তা বলা হয়নি, কারণ মানবতার মুক্তিকামি ধর্ম ইসলাম এমন কুপমণ্ডপকতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। বরং সবসময় জ্ঞান অন্বেষণ এবং যেখানেই পাওয়া যায় তা আহরণে উৎসাহীত করে। এই অন্বেষণের সীমা নির্ধারণ করেনি। মাযহাবের ইমামরাও তাদের চেয়ে ভালো কিছু পেলে সেটিই মানতে বলেছেন।
আমার নিজের সীমাবদ্ধতা আছে বলেই মাজহাবের সম্মানিত ও সর্বকালের স্বীকৃত ইমাম সাহেবানদের যে কোনো একজনকে ফলো করতে হচ্ছে। শুধু একজনকে কেন? যে বিষয়ে যার মতকে বেশী যৌক্তিক মনে করছি তাঁরটি ফলো করতে ভালো লাগে। তাই বলে যে কাউকে কোনো একজনে আটকে থাকতে হবে, তারও কোনো বিধান আছে বলে জানি না। তাছাড়া বিগতদিনের উলামা বা ইসলামিক স্কলারদের চেয়ে যে কারো যে কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ, বর্জনের মানসিকতা পোষণ করি। কিন্তু কারো মত প্রকাশে বাঁধা দিতে পারি না। আর মনে করি, একজন সচেতন মানুষের তা-ই করা উচিত। যেখানে বা যার কাছে উত্তম কিছু পাওয়া যাবে সেটাই গ্রহণ বা অনুসরণ করাই হবে শিক্ষিত ও বোধসম্পন্ন মানুষের কাজ। আর ভালো মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ের জন্যতো স্রষ্টা প্রদত্ত বিবেকই যথেষ্ট।
পবিত্র রামাদ্বানের অন্যতম শিক্ষাই হচ্ছে সংযম। আসুন, রামাদ্বানের অন্যতম এই মৌলিক শিক্ষায় জীবন গঠনের মাধ্যমে পরমতসহিষ্ণু হয়ে সামাজিক শান্তি-স্থিতি প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হই।
লেখক, কাইয়ুম আব্দুল্লাহ : কবি, লন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা সুরমার বার্তা সম্পাদক।