বৃদ্ধ বয়সের একটা বিশেষ সুবিধা আছে, হাসি-কান্না-আবেগের দুস্তর পথ না পেরিয়েও শৈশব-কৈশোরের অম্ল-মধুর স্মৃতিগুলো উপভোগ করা যায়। ইন্টারনেটে খবর পড়ছি বাংলাদেশের এখানে-সেখানে প্রচণ্ড শীত পড়েছে, বিশেষ করে দরিদ্র জনমানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। ভূগোলের সংজ্ঞায় বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ, আর বিগত ৫৪ বছর ধরে আমি আছি যে যুক্তরাজ্যে, সেটা একটা শীতপ্রধান দেশ। এ দেশে শীত বেশি হবেই এবং আমি বরাবরই শীতকাতুরে। বন্ধুদের আমি রসিকতা করে বলি, আমি গোশতের চেয়ে মাছ বেশি খাই, আমার রক্তও সে জন্য বেশি ঠাণ্ডা।
আমার স্ত্রীর কিন্তু এত শীত লাগে না। আমাদের বাড়িতে এটা চিরাচরিত ব্যাপার। শীতকালে আমি লুকিয়ে সেন্ট্রাল হিটিং বাড়িয়ে দিই, আবার সুযোগ পেলে স্ত্রী লুকিয়েই কমিয়ে দেন। বন্ধুরা কেউ এলে এ নিয়ে স্ত্রীর অভিযোগের শেষ নেই। আমরা এ দেশে এসেছি ৫৪ বছর আগে, ১৯৬০ সালে। সাধারণ বসতবাড়িতে তখনো সেন্ট্রাল হিটিং বসেনিÑ যদিও হাসপাতাল, অফিস-আদালতের বড় ভবনগুলোতে সেন্ট্রাল হিটিং বসেছে। যুক্তরাজ্য তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অর্থনীতির পুনর্গঠন তখনো ছিল প্রথম জাতীয় অগ্রাধিকার। আমাদের বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং প্রথম বসে ১৯৬৫ সালে। তার আগ পর্যন্ত বয়লারে কয়লা জ্বালিয়ে বাড়ি গরম রাখা এবং পানি গরম করা হতো। শীতের কুয়াশা এবং চিমনি নিঃসৃত কয়লার ধোঁয়া মিশে ঘন ‘স্মগ‘ বা ধোঁয়াশা হতো। আমি নিজেও দেখেছি ধোঁয়াশায় নিজের হাতটি পর্যন্ত দেখা যেত না। সহজেই বোধগম্য যে, ধোঁয়াশার বিষাক্ত বাতাস ফুসফুসের জন্য খুবই ক্ষতিকর হতো। ১৯৬২-’৬৩ সালের ধোঁয়াশায় যুক্তরাজ্যেও কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
অবশ্য তার চেয়েও কয়েক গুণ মানুষ তখনো প্রতি শীতেই মারা যেত স্টালিনশাসিত বিশাল সোভিয়েত সাম্রাজ্যে। স্টালিনের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল সমরাস্ত্রে, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের চেয়েও এগিয়ে যাওয়া। শ্রমশিল্প বিকাশের বেলায়ও সেটাই ছিল বড় বিবেচনা। সব রকমের জ্বালানি এসব উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। সাধারণ মানুষের বাড়ি গরম রাখার জন্য কয়লা দেয়াকে স্টালিন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেননি। সাধারণ মানুষ এক পরত কাপড় পরে তার ওপর কয়েক পরত পুরনো খবরের কাগজ জড়িয়ে তারও ওপর আবার আরেক পরত জামাকাপড় পরত। এই খবরের কাগজের পরতগুলো সেই যে শীতের শুরুতে পরত তারা, খুলত গিয়ে একেবারে ভরবসন্তে। বিচিত্র নয় যে, প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ শীতজনিত কারণে মারা যেত।
দেশী শীতের সকালবেলা
আমাদের নাতিশীতোষ্ণ দেশে ছোটবেলার শীতের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। পত্রিকাগুলো বেরোত কলকাতা থেকে। বিলেতে জন লগি বেয়ার্ড নামে একজন স্কটসম্যান টেলিভিশন আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু ভারতবর্ষে দু-একজনের বেশি সে খবর জানতেন বলে মনে হয় না। রেডিও খুব কম লোকের বাড়িতে ছিল। দেশের কোথায় বেশি শীত পড়েছে কি পড়েনি, জানার উপায় ছিল না। শীতকালে স্কুলে বড়দিনের ছুটি হতো। আমরা কলকাতা থেকে নোয়াখালী গ্রামের বাড়িতে আসতাম। শেয়ালদা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ (দৌলতদিয়া) পর্যন্ত ভালোই কাটত। ধর্মতলা স্ট্রিটে ওয়াছেল মোল্লার দোকান থেকে আব্বা ‘গরম কোট’ কিনে দিয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বড় ভাইয়ের হাফহাতার সোয়েটারের ওপর সে কোট পরে দিব্যি আরামেই থাকতাম। কিন্তু গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে চাঁদপুর পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পদ্মা আর মেঘনার হিমেল বাতাসে রীতিমতো শরীরে কাঁপ ধরত। স্টিমারের ইঞ্জিনের পাশে ঘুরঘুর করতাম, আরামদায়ক গরম বাতাস আসত ইঞ্জিন থেকে।
============ গ্রামের বাড়িতে খুব মজা ছিল তখন। সকালবেলা ঘুম ভাঙলেই আম্মা-চাচীরা জিজ্ঞেস করতেন কে কী পিঠা খাবে। ছুটির সেই মওসুমে চাচাতো-ফুফাতো আর খালাতো ভাইবোন মিলে অনেক শিশু আমরা জড়ো হতাম আমাদের একান্নভুক্ত বাড়িতে। তাদের নিয়ে মৃদুমন্দ রোদে সারা দিন আনন্দে কাটত। সন্ধ্যার পরই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে মহিলারা আগুনের ভাণ্ড নিয়ে বসতেন, গল্পগুজারি করতেন। আব্বা-চাচারা কাচারি বাড়িতে চাদর কিংবা শাল গায়ে দিয়ে বৈষয়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। কোনো কোনো সন্ধ্যায় আমাদের কিংবা আশপাশের গ্রামের কেউ আসতেন ধর্মীয় কোনো বিষয়ের মীমাংসা শোনার উদ্দেশ্যে। আমরা শিশুরা লেপ-কাঁথা আর বালিশ নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতাম।
আরো আগে দাদা বেঁচে ছিলেন। ভোরে নামাজ পড়ে তিনি হাঁটতে বেরোতেন। তার সাথে হাঁটতে যেতে আমার খুব ভালো লাগত। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন তিনি। আদর করে ‘ভাই’ বলে ডাকতেন। অনেক গল্প শুনিয়েছেন তিনি। কিন্তু ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরে আমার জুতো ভিজে যাবে, তাই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতাম আমি, টপকিয়ে টপকিয়ে, যেখানে যেখানে তার চটিজুতো ভেজা ঘাসকে চ্যাপ্টা করে দিত।
আমাদের দেশ তখন ছিল ইংরেজের ভারত সাম্রাজ্য। তারা এসেছিল শোষণ করতে। শোষণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি কিছু তারা আমাদের দেয়নি। বিদ্যুতের লোডশেডিং কিংবা রান্নার গ্যাসের স্বল্পতার প্রশ্নই ওঠেনি। গ্রামে দূরের কথা, যে কলকাতা মাত্র কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, সেখানেও সব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগেনি। আমার মনে আছে, আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি মাত্র তখনই আমাদের ভাড়া বাসায় বিজলি বাতি লেগেছিল। তার আগ পর্যন্ত হ্যারিকেনের আলোতেই পড়াশোনা করতে হতো। সুতরাং দেশের অন্য কোথাও বেশি শীত পড়েছিল কি না জানার উপায় ছিল না।
প্রগাঢ় অসম বন্ধুত্ব
বেশ কিছু বছর পর একদিন শুনেছিলাম। আমি তখন ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের সম্পাদক। আমাদের লাইব্রেরিতে নিয়মিত বিলেতের পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন আসত। ইংরেজ তখন ভারত ছেড়ে গেছে, আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। কিন্তু ব্রিটিশদের অনেক খয়ের খাঁ তখনো অবশিষ্ট ছিলেন। তাদের কেউ কেউ প্রতিদিনই আসতেন, লাইব্রেরিতে বসে বিলেতের খবরসবর পড়তেন। তাদের একজন ছিলেন ভারতের প্রথম বাঙালি মুসলমান আইসিএস অফিসার টি আই এম নূরুন্নবী চৌধুরী। তার সাথে আমার প্রগাঢ় অসম বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমার অফিসে চা-কফির সুবন্দোবস্ত ছিল। একদিন আমন্ত্রণ করেছিলাম। সেই থেকে তিনি আমার নিয়মিত অতিথি হয়ে গেলেন। বিলেতি কায়দায় ঘড়ি ধরে বেলা ১১টায় তিনি আমার অফিস ঘরে ঢুকতেন। আমরা কফি খেতাম আর গল্প করতাম। নূরুন্নবী চৌধুরী নিবেদিতপ্রাণ সমবায় কর্মী ছিলেন। একদিন তিনি গল্প শোনাচ্ছিলেন সমবায় আন্দোলনের সপক্ষে তার জনসভা সম্বন্ধে। তিনি তখন গফরগাঁওয়ের এসডিও (মহকুমা প্রশাসক)। তখন বেলা ডুবু ডুবু করছে। উত্তুরে শীতের বাতাস বইছে কন কন করে। এক বৃদ্ধলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাতজোড় করে বললেনÑ ‘হুজুর, সমবায় করলে আমি কি গায়ে দেবার একটা চাদর পাবো?’
চৌধুরী সাহেবের পুরনো আবেগ যেন নতুন করে জেগে উঠল। বললেন, ‘আমার সব রক্ত যেন মাথায় চেপে গেল। আমার দেশের মানুষের শীতে গায়ে দেয়ার একটা চাদরও নেই। আর আমি স্যুট-কোট পরে তার সামনে বক্তৃতা দিচ্ছি। আমি কোট খুলে ছুড়ে ফেলে দিলাম। হেঁচকা টানে শার্টটা ছিঁড়ে ফেললাম। তারপর গিয়ে আমার মাথা ঠাণ্ডা হলো।’ আমি বললামÑ ‘চৌধুরী সাহেব, আরো তো ভালো সমাধান ছিল। আপনি যদি লোকটাকে দুটো টাকা দিতেন তাহলে সে একখানা চাদর কিনতে পারত, আর আপনাকেও নতুন একটা শার্ট কিনতে হতো না।’ নূরুন্নবী চৌধুরী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন। তারপর সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। বলেন, ‘এ জন্যই আপনার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। আপনি সব সমস্যার এমন সহজ সমাধান বলে দেন!’ টি আই এম নূরুন্নবী চৌধুরীর এমন বহু উদ্ভট, তবে মধুর গল্পের কথা প্রায়ই মনে পড়ে।
তখনো গোপীবাগে আমাদের ভাড়া বাসাতে বিদ্যুৎ ছিল না। আমি রেডিওতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতাম। বিশেষ করে বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৮টায় সংবাদপরিক্রমা। স্ত্রীর শোনার সুবিধার জন্য মোটরগাড়ির ব্যাটারির মতো বিরাট ব্যাটারিচালিত একটা রেডিও কিনেছিলাম। ছোট ব্যাটারিচালিত ট্রানজিস্টার রেডিও বাজারে বেরিয়েছিল তার ২০-২৫ বছর পরে। আমার ছেলে স্বপন সে দিন সন্ধ্যায় রেডিওতে শোনা আমার কণ্ঠস্বর চিনে ফেলেছিল। নাজিমুদ্দিন রোডের ব্রডকাস্টিং হাউজ থেকে রিকশায় বাড়ি ফিরতেই শিশু বলে উঠলÑ ‘বাব্বু, তুমি কী করে রেডিওতে ঢুকে যেতে পারলে?’ সেই স্বপন প্রয়াত হয়েছে তিন বছর হতে চলল।
পিতার ভুল পুত্রীর ঘাড়ে
বলার কথা হলো সেকালে বিদ্যুৎ ছিল না, গ্যাসও ছিল না। সুতরাং এ দুই জ্বালানিশক্তির অভাববোধও ছিল না মানুষের। সব চেয়ে বড় কথা, ইংরেজ শাসকদের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার সাহস ছিল না মানুষের। এখন সব কিছু পাল্টে গেছে। পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন-ইন্টারনেটের কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীর খবর জানা হয়ে যাচ্ছে। আমরা স্বাধীন হয়েছিÑ একবার নয়, দু-দু’বার।
আমাদের এখন সাহস হয়েছে, কণ্ঠে কথা ফুটেছে। বড় হয়ে শিখেছি, সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল কথা। আমরা শিখেছি যা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সেটা দাবি করার, জোর করে আদায় করে নেয়ার অধিকারও আমাদের আছে এবং বিজলি ও গ্যাস এখন রাজনৈতিক, নির্বাচনী ইস্যু। ছয় বছর আগে এ রকম সময় শেখ হাসিনা মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন, ভোট দিয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হলে রাতারাতি বিদ্যুতের সয়লাব বইয়ে দেয়া হবে, রান্নার গ্যাসের অভাব থাকবে না, দশ টাকা কেজির চাল খাবে বাংলাদেশের মানুষ।
সেসব প্রতিশ্রুতি কতটুকু পালন করা হয়েছে, আপনারা অবশ্যই জানেন। শেখ হাসিনা এখন আর এমন ব্যবস্থা চান না, যাতে তাকে নতুন করে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট চাইতে হবে। তিনি সাব্যস্ত করেছেন তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে যেভাবে স্বৈরতান্ত্রিক একদলীয় পদ্ধতিতে বরাবরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, তিনিও সে রকম কোনো পদ্ধতিতে আজীবন রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী হবেন। সে লক্ষ্যে এ বছরের ৫ জানুয়ারি তিনি নিজস্ব টেকনিকে একটা নির্বাচন-নির্বাচন খেলা খেলেছিলেন। ভোট দেয়ার তারিখের কয়েক দিন আগেই ঘোষণা দেয়া হয় যে, সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে। নির্ধারিত তারিখেও কোনো ভোটদাতা ভোটকেন্দ্রে যাননি। কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ঘুমুচ্ছিলেন চেয়ারে বসে, আর বেওয়ারিশ কুকুরগুলো মাটিতে শুয়ে। ভিডিও-ইন্টারনেটের দৌলতে সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে সেসব ছবি এবং মনে মনে নিশ্চয়ই খুব হেসেছে। ওদিকে বাংলাদেশে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে বিপুল গরিষ্ঠতায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। সেই সাথে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটা গৃহপালিত বিরোধী দলও গঠন করে নেয়া হয়েছে। সে দলের সদস্যরা সরকারের মন্ত্রীও হবেন, আবার বিরোধিতাও করবেন।
আজব দেশে অ্যালিসের গল্প বাংলাদেশে
কিন্তু আজব দেশে অ্যালিসের গল্পের মতো শেখ হাসিনার নির্বাচনী খেলাকেও কেউ বিশ্বাস করেনি। যে দেশে তিনি যাচ্ছেন যে দিকে তিনি তাকাচ্ছেন সর্বত্রই একই কথা : ‘ইয়ে ইলেকশান ঝুটা হায়।’ সবাই বলছেন এমন একটা নির্বাচন দাও দুনিয়ার মানুষ যেটাকে বিশ্বাস করতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ যে নির্বাচনকে গ্রহণ করতে পারে। শুনে শুনে দখলদার সরকারের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তারা স্থির করেছে নির্বাচন দিলেই যখন এত কথা ওঠে তখন নির্বাচন না দেয়াই ভালো। ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকার জন্য তারা নতুন মডেল আর নতুন টেকনিক খুঁজছে।
স্টালিনের মডেলকে কিছুটা সাফ-ছুতরো করে পাকিস্তানের ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সড়কের ময়লা পরিষ্কার আর কয়েকটা কলকারখানা স্থাপন করে। তারপর ভেবেছিলেন যে, তার টোপ পাকিস্তানের মানুষ গিলেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে আইয়ুব খান ‘ডেকেড অব ডেভেলপমেন্ট’ (উন্নয়নের দশ বছর) পালন করলেন। ভেবেছিলেন যে তার গদি পোক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের মানুষও এত বোকা-পাঁঠা ছিল না। খাইবারপাস থেকে শুরু করে বান্দরবান পর্যন্ত মানুষ রুখে দাঁড়াল। ডেকেড অব ডেভেলপমেন্টের কয়েক মাসের মধ্যেই আইয়ুব খান ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ বলে বিদায় নিয়েছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কুশাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছিল।
লে. জে. এরশাদ গদি দখল করেছিলেন ষড়যন্ত্র করে, একটি দল ও মহলের সহযোগিতায়। মডেল খোঁজার জন্য তাকে বেশি দূর যেতে হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন তার সাবেক ‘বস‘ আইয়ুবের মডেলই যথেষ্ট হবে, পাকিস্তানের মানুষ আইয়ুবি মডেল বাতিল করলেও বাংলাদেশের মানুষ সে মডেল লুফে নেবে। তিনিও মেলা ‘উন্নয়ন, উন্নয়ন’ করেছেন, কিন্তু গণতন্ত্র নামের যে বস্তুটার সন্ধান মানুষ পেয়েছিল সেটি ছাড়া নকল কিছু মেনে নিতে বাংলাদেশের মানুষও রাজি হয়নি। জেনারেল এরশাদ কেমন নাস্তানাবুদ হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন আমিও দেখে এসেছি।
উত্তর কোরিয়ার মডেল ধরেছে এই সরকার
শেখ হাসিনা মডেলের খোঁজে আরো দূরে দৃষ্টি দিয়েছেন। কিম ইল-সুং উত্তর কোরিয়ায় নতুন মডেলের স্বৈরতন্ত্র চালু করেছিলেন। গণতন্ত্রের নাম মুখেও আনেননি তিনি, এমনকি আইয়ুব খানের মতো মৌলিক গণতন্ত্রেরও নয়। রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে তাক লাগানো কয়েকটা ইমারত করেছিলেন তিনি, আর বিরাট একটা সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও শুনছি গণতন্ত্রের তোয়াক্কা ছেড়ে দিয়েছে, শুনেছি তাদের নতুন স্লোগান হবে ‘গণতন্ত্র নিপাত যাক‘। ‘উন্নয়ন-উন্নয়ন‘ স্লোগান তুলে তারা তাদের দখলি স্বত্বকে কায়েমি স্বত্বে রূপান্তরিত করতে চায়। কিন্তু সরকার ভুলে যাচ্ছে কিম ইল-সুংয়ের তৃতীয় প্রজন্মে, তার নাতি কিম জং-উনের গদি লাভের কয়েক বছরের মধ্যেই সে মডেল টলোমলো কাঁপছে। ব্যর্থ মডেলগুলোর কোনোটি নকল করেই বাংলাদেশের এই সরকার টিকে থাকতে পারবে না। উন্নয়ন অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষ চায়। কিন্তু তারা উন্নয়ন চেয়েছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধে তাদের একটাই দাবি ছিল। সে দাবি গণতন্ত্রের। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে সরকারের ‘উন্নয়ন-উন্নয়ন’ স্লোগান সে জন্যই সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। মুসলমানকে আল্লাহ-রাসূলের নাম আর কালেমা ভুলে যেতে বলা যেমন চরম অপমান, বাংলাদেশের মানুষকে গণতন্ত্র ভুলে যেতে বলাও সমান অপমান।
বাংলাদেশে এখন শীত পড়েছে, যুক্তরাজ্যেও তীব্র শীত। যুক্তরাজ্যের আমাদের এলাকায় এবার এখনো বরফ পড়েনি। বরফ জিনিসটা বিচিত্র। শীত বেশি হলে বরফ পড়ে না, বরফ পড়ে গেলে শীত কিছুটা কমে যায়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক শীতের চেয়েও প্রতীকী রাজনৈতিক শীতই বেশি সাংঘাতিক। কিন্তু ভরসা আছে, এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক শীতও বেশি দিন সহ্য করতে রাজি হবে না। তাদের চোখ-কান খুলেছে, তারা কথা বলতে, প্রতিবাদ করতে শিখেছে এবং রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে তারা সচেতন। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয় কখনো অন্যায় আর অত্যাচার সহ্য করে না।