রাতের খবর শুনতে গিয়ে আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দুঃস্বপ্নের ঘোরে রাত কাটল। সকালে পত্রিকার খবরটি দেখে আমি আমার পরিচিত নারী সংগঠকদের ফোন করে বিষয়টি সম্পর্কে মতামত দেওয়ার কথা জানালাম।
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে নামিয়ে ১৬ বছর করার জন্য মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত হচ্ছে। আমি দীর্ঘ এ জীবনে প্রতিদিনের কার্যক্রমের মধ্যে সব সময়ই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছি—বয়সটি ১৮ থেকে আরও একটু বাড়ানো যায় কি না। গ্রামে কাজি সাহেবদের সঙ্গে আলোচনা করে বলেছি এই বয়সে বিয়ের ভয়াবহতার কথা। ইমাম সাহেবদের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, খুতবা দেওয়ার সময় মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের ক্ষতিকারক দিকটা তুলে ধরে গর্ভকালটা যেন চিকিৎসকের পরামর্শে চলে, সে ব্যাপারে কিছু বলতে। সেই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই ঘটনা।
ষোড়শী একটি কন্যা তার নিজের দেহের পরিবর্তনটাই বুঝতে পারে না। খোলামেলাভাবে যদি বলি, ‘মাসিকের কাপড়টি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে’, ‘কয়বার ব্যবহার করতে হবে’, ‘কীভাবে পরিষ্কার করতে হবে’—কিছুই সে জানে না। কারণ, বাড়িতে ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখতে বলা হয়, কারও সামনে আলোচনা করা যাবে না। পাঠ্যবইয়ে প্রজননের ওপর কিছু জেনেছে সে তেলাপোকা এবং ব্যাঙের জীবন পড়ে, মানবদেহের পরিবর্তনের কথা তার অজানা। বাড়িতে মা-বোনদের সঙ্গে কথাটি আলোচনা করতে গেলে বলা হয় এটি লজ্জার ব্যাপার, এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা নয়। কাজেই দেহের পরিবর্তনের ব্যাপারটা শুধুই লুকিয়ে রাখা, এর ভালো-মন্দ জানার অধিকার তার নেই। এরই মধ্যে তাকে যখন অন্য আরেকটি পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং পরিচিত-অপরিচিত একজন পুরুষের সঙ্গে একটি বাক্যবিনিময়ের মধ্যে সঙ্গমে পাঠানো হয়, সেটিকে ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কারণ, ১৬ বছর বয়সটিতে তার মানসিক এবং শারীরিক কোনো দিক থেকে সে নতুন এ জীবনটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। জীবনের প্রথম ওই রাতের অভিজ্ঞতায় অনেকের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা এলেই ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সন্তান না নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রক তার জন্য গ্রহণযোগ্য হয় না, সে গ্রহণ করতে পারে না এবং অতিদ্রুত সে গর্ভধারণ করে।
শরীরটা গর্ভ নেওয়ার জন্য পরিপূর্ণ তৈরি নয় বলেই অ্যাবরশনও বেড়ে যায়। সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায়, কুড়ির আগে এবং পঁয়ত্রিশের পর যারা গর্ভধারণ করে, তাদেরই অ্যাবরশন হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। শুধু তা-ই নয়, সময়ের আগেই তাদের সন্তান জন্ম হয়ে যায়, যাকে আমরা বলি প্রি–টার্ম ডেলিভারি এবং এই প্রি–ম্যাচিউর বাচ্চার মৃত্যুর হার অনেক বেশি এবং যেগুলো বেঁচে যায় তাদের জীবনের জটিলতাও অনেক বেশি এবং এসব জটিলতায় একটি বিশাল দায়িত্ব পরিবার, সমাজ এবং দেশকে বহন করতে হয়। পূর্ণ সময়ে ডেলিভারি হলেও তাদের দেহ যেহেতু ঠিকভাবে তৈরি নয়, সে জন্য বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং বিলম্বিত প্রসব তাদের বেশি হয়। ফলে মা ও শিশু দুজনের জীবনই ঝুঁকিপূর্ণ হয়। মায়ের যোনি ছিঁড়ে পায়খানা ও যোনিপথ এক হয়ে যায় এবং অনেক পরিবারে এভাবেই তাকে দীর্ঘ জীবন কাটাতে হয়, অনেকেরই প্রস্রাব ও যোনিপথ এক হয়ে গিয়ে সারাক্ষণ প্রস্রাব ঝরতে থাকে। এ ধরনের নারীকে স্বামী ত্যাগ করে, সংসার তাকে গ্রহণ করতে চায় না, ভয়ানক একটি দুর্বিষহ জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে তাদের জন্য একটি আলাদা বিভাগ (Fistula Centre) খোলা হয়েছে এর সংখ্যার ভয়াবহতার জন্য।
গর্ভকালীন ও গর্ভ-পরবর্তী সময়ে তাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো পুষ্টিই তারা পায় না, যার ফলে সন্তানটিও অপরিপক্ব হয় এবং নিজেও অপুষ্টিতে ভুগে পরবর্তী সময়ে যে কষ্টে ভোগে, স্বামীর ঘর করা তার জন্য কষ্টদায়ক হয়। তখন তাকে সূতিকা রোগী আখ্যা দিয়ে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
যাঁরা হয়তো বা কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই সময়টি পার করতে পেরেছেন, তাঁরা যদি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন, তবে তাঁদের দ্রুতই চাপ দেওয়া হয় পরবর্তী সন্তানের জন্য এবং সেটি যেন পুত্রসন্তান হয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৮-১৯ বছরের মধ্যেই তিনি দুই-তিন সন্তানের মা হয়ে গেছেন। তাঁরা নিজেরাও অপুষ্টিতে ভোগেন, সন্তানেরাও কেউই ঠিক পরিমাণমতো বুকের দুধ পায় না এবং অপুষ্টিতে ভোগে। এর দায়ভারটি কি শুধুই তাঁর? সমাজ-সংসার এবং দেশকে কি এর দায়ভার নিতে হয় না?
গর্ভধারণের সময়ের আরও একটি ভয়াবহ জটিলতা হলো একলাম্পশিয়া অথবা খিঁচুনি। এই জটিলতায় শিকারের সংখ্যাও বেশি এবং এতে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি। এসব জটিলতার সংখ্যা বেশি হওয়াতে প্রতিটি মেডিকেল কলেজে আলাদা ওয়ার্ড (একলাম্পশিয়া ওয়ার্ড) খোলা হয়েছে। গ্রাম পর্যায়ে তাঁকে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে জিন-ভূতের আছর বলে ঝাড়ফুঁক করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
সন্তান গর্ভধারণের বিভিন্ন জটিলতার পাশাপাশি তিনি স্ত্রীরোগের নানা জটিলতায় ভুগছেন। তার মধ্যে PID-এর (Pelvic Inflammatory Disease) কষ্টে ভুগছেন। সারাক্ষণ তলপেটে ব্যথা, গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব, জরায়ুর প্রদাহ ইত্যাদি নিয়ে ভুগতে ভুগতে স্বামী-সংসারজীবন তাঁর দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, স্বামীর পরিবার তখন চিন্তা করে, মেয়েটি স্বামীর ঘর করার অনুপযুক্ত, তাই স্বামীর অন্যত্র বিয়ের প্রয়োজন। সবচেয়ে ভয়াবহ যে জটিলতা তাঁকে আক্রান্ত করে সেটি হলো জরায়ুর মুখের ক্যানসার। বাংলাদেশের এই অসুখের সংখ্যা অনেক বেশি এবং শুধু এই অল্প বয়সে বিয়ে এবং সন্তান নেওয়াই হচ্ছে এর প্রধান কারণ। এই ক্যানসার বন্ধ রাখার প্রকল্পে সরকার/এনজিও/বিভিন্ন সংগঠন গ্রামপর্যায় থেকে শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নানা ধরনের কার্যক্রম নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও প্রতিনিয়ত জরায়ুর মুখের ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা দ্রুতই বাড়ছে।
ইতিমধ্যে অনেক সভা-সমিতিতে সম্মানিত বক্তারা অনেক কথা বলেছেন। আমি শুধু স্বাস্থ্যগত দিক থেকে কীভাবে একটি ষোড়শী মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়, তার খতিয়ান দিলাম। আমি জানি, বর্তমান সরকারই নারীকল্যাণমুখী সরকার, কাজেই তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে আবারও ভাববে।
রওশন আরা বেগম: অধ্যাপিকা ও বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ), হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
সৌজন্যে : প্রথম আলো