২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ : জার্মানি বার্লিন শহরে পেত্রিপালট্জ-এ নির্মিত হচ্ছে ‘হাউজ অব ওয়ান’। এক ছাদের নিচে তিন ধর্মের উপাসনালয়। বিশ্বব্যাপী যখন ধর্মীয় দ্বন্দ্ব-বিবাদ চলছে, তখন মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের মধ্যে একতা আনার উদ্দেশ্যে অভিনব এ ধারণাটি প্রস্তাব করেন রেভারেন্ড গ্রেগর হোবার্গ (৪৬)। প্রোটেস্ট্যান্ট এ ধর্মযাজকের বিশ্বাস এ পদক্ষেপটি প্রতিধ্বনিত হবে বার্লিনের সীমান্ত পেরিয়ে। তারা এ উপাসনালয়ের নাম দেবেন ‘হাউজ অব ওয়ান’। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়য়ের শিক্ষা থেকে এ ধারণাটি নিয়েছেন গ্রেগর। যে স্থানটিতে নতুন এ উপাসনালয় নির্মিত হচ্ছে সেখানে প্রতীকী ইট হাতে নিয়ে একসঙ্গে দেখা যায় রেভারেন্ড গ্রেগর হোবার্গ, র্যাবাই তোভিয়া বেন-চোরিন ও ইমাম কাদির সানচিক। শহরের কর্মকর্তাদের অনুমোদনের পর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বেছে নেয়া হয় একটি নকশা। নির্মাণকাজের জন্য তহবিল গঠনে চলছে প্রচারণা। আয়োজকদের প্রত্যাশা দুই বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। এ পরিকল্পনা নতুন একটি উদ্যোগের অংশ, যার উদ্দেশ্য অভিনব ধর্মীয় যোগসূত্র স্থাপন। এর মধ্যে একটি উদ্যোগ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ওমাহাতে ‘ট্রাই ফেইথ ইনিশিয়েটিভ’। তিন ধর্মের এ উদ্যোগের অধীনে, সম্প্রতি নির্মিত একটি সিনেগগের পাশাপাশি একটি চার্চ ও একটি মসজিদ নির্মাণের প্রচেষ্টা চলছে। বার্লিনের ‘হাউজ অব ওয়ান’ সম্ভাবনার অগ্রগতি হলেও, অভিনব এ প্রকল্প ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রতিবন্ধকার সম্মুখীন হয়েছে। সবগুলো ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই এ প্রকল্পটি উল্লেখযোগ্য মানবিক সমর্থন অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। পক্ষান্তরে রয়েছে সমালোচনাও। বার্লিনের তুর্কি মুসলিম জনসংখ্যার অনেকে প্রগতিশীল ওই ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অন্য ধর্মের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি কোরআন লঙ্ঘন করেছেন বলে তাদের অভিযোগ। শহরের অন্য মুসলিমরা এদিকে ‘ফোরাম ফর ইন্টারকালচারাল ডায়ালগ’-এর সঙ্গে ইমামের সংশ্লিষ্টতার কারণে সন্দেহ পোষণ করেছেন। কেননা ওই ফোরামের অনারারি চেয়ারম্যান হলেন ফেতুল্লাহ গুলেন- যিনি ভিন্ন মতাবলম্বী একজন তুর্কি ধর্মীয় নেতা। বার্লিনের খ্রিষ্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও আপত্তি রয়েছে। এর মধ্যে অনেকের দাবি, যে নকশাটি বাছাই করা হয়েছে সেটা বেশি দেখতে মসজিদের মতো। সম্ভবত সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, চূড়ান্ত ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপের এ শহরটিতে মানুষের ধর্ম-অনীহা জয় করা। এ শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা আজকাল কোন ধর্মের অনুসারী নয়। বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির আধুনিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক মানফ্রেড গাইলুস বলেন, ‘আমি মনে করি এ প্রকল্পের জন্য কিছু সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি বর্তমান পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টিপাত করেন তাহলে দেখবেন, অনেক মানুষ আজকাল ধর্ম নিয়ে তেমনটা পরোয়া করে না। হয়তো কিছু মানুষ বলছে, ওহ এটা দারুণ একটা ধারণা। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন করবে, আসলে এর কি কোন প্রয়োজন আছে? আর এতে কত ব্যয় হবে।’ উপাসনালয়টি নির্মাণে প্রয়োজন ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর এ তহবিল গঠন করতে গিয়ে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন আয়োজকরা। তার পরও তাদের বিশ্বাস নির্মাণকাজ শুরু করতে প্রয়োজন ১ কোটি ২৭ লাখ ডলার দুই বছরের মধ্যে জোগাড় করা সম্ভব। জুলাইতে শুরু হওয়া প্রচারণায় এ পর্যন্ত তহবিলে জমা হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২ হাজার ডলার। এই হারে চলতে থাকলে প্রয়োজনীয় তহবিল গঠনে দুই দশকেরও বেশি সময় লাগবে। তবে ‘হাউজ অব ওয়ান’ সমর্থকেরা দারুণ আশাবাদী। তারা বলছেন, লক্ষণীয় হলো প্রকল্পটি এত দূর পর্যন্ত এসেছে। নির্মাণের জন্য ঐতিহাসিক একটি স্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। শহর কর্তৃপক্ষের সমর্থন রয়েছে। তিন ধর্মের পক্ষ থেকে সমর্থন মিলেছে। সব মিলিয়ে তাদের বিশ্বাস এ প্রকল্পটি আর্থিক ও আধ্যাত্মিক যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাই উৎরে যাবে। প্রকল্পটি এখন প্রধান তিন একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাসের ধর্মযাজকদের কেন্দ্র করে এগুচ্ছে। একজন খ্রিষ্টান রেভারেন্ড যিনি পূর্ব জার্মানির দমন-পীড়ন প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন বার্লিনের পতনের পর একতার ক্ষমতা। আছেন একজন উদীয়মান মুসলিম ইমাম। যিনি জন্মেছেন ফ্রাঙ্কফুর্টে। যিনি মুসলিম ও নন-মুসলিমদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে আগ্রহী। আর আছেন জার্মান বংশোদ্ভুত ইহুদি রাবাই যিনি ইসরাইলের হয়ে তিনটি যুদ্ধে লড়েছেন। এখন পুরনো ক্ষত নিরাময়ে আত্মনিয়োগ করেছেন। হাউজ অব ওয়ানের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যেন প্রতিটি ধর্মানুসারীরা পৃথক কক্ষে উপাসনা করতে পারেন। তিন ধর্মের তিন ধর্মযাজক, গ্রেগর, বেন-চোরিন ও কাদির সানচি জানালেন, এখন পর্যন্ত সব থেকে কড়া সমালোচনা এসেছে বার্লিনের মুসলিমদের পক্ষ থেকে। ইমাম কাদির সানচি এ উদ্যোগে সামিল হওয়ার আগে অনেক ইমাম ‘হাউজ অব ওয়ান’ এ যোগ দেয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি যোগ দেয়ার পর টুইটার, ফেসবুকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য পেয়েছেন। তার পরও আত্মবিশ্বাসী ইমাম কাদির সানচি। সূত্র: মানবজমিন