বৃটেনে নতুন এক ইতিহাস গড়লেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হাবিবুর রহমান। ৮০০ বছরের ইতিহাসে নিউক্যাসেলে প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে লর্ড মেয়র পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাকে। বুধবার এ দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছেন তিনি। এ সময় বক্তব্যে তিনি পিতামাতার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষের জন্য সমান কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হাবিবুর রহমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এ খবর দিয়েছে বৃটেনের অনলাইন ক্রনিক্যাল লাইভ। হাবিবুর রহমান মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৮৫ সালে পিতামাতা ও ৬ ভাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ছেড়ে বৃটেনের টাইনসাইডে চলে যান।
তখন তিনি ইংরেজি বলতেই পারতেন না। অথচ তিনি এখন এলসউইকের নির্বাচিত কাউন্সিলর। নিউক্যাসলে লর্ড মেয়র পদে তিনি ডেভিড কুকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তার এ নিয়োগ এক বছর বিলম্বিত হয়েছে করোনা ভাইরাসের কারণে। বার্ষিক জেনারেল মিটিংয়ে তিনি নিউক্যাসল সিটি কাউন্সিলে এ পদে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হন। তিনি বিরোধী লেবার দলের সমর্থক। দুই বছর নিউক্যাসেল শেরিফ এবং ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন হাবিব। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরই তিনি গভীর আবেগঘন বক্তব্য রেখেছেন। এ সময়ে তিনি উৎসাহ দেয়ার জন্য তার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। সরাসরি তার প্রয়াত পিতা আজিজুর রহমানকে নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন।
১৯৭৭ সালে তার পিতা আজিজুর উন্নত জীবনের সন্ধানে ওই শহরে যান। তিনি কাজ করতেন ওয়ালসেন্ড রেস্তোরাঁয়। সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ কাস্টমারকে দেয়া কারি’র পরিমাণ পছন্দ না হওয়ার কারণে, ওই কাস্টমার তাকে ছুরিকাঘাত করে। এতে মাত্র ১০দিন পরেই মারা যান আজিজুর রহমান। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার সময় হাবিবুর রহমান তার সহকর্মীদের বলেছেন, নিউক্যাসেলে তার শৈশবের দিনগুলো বাধাগ্রস্ত হয়েছিল নিষ্ঠুর বর্ণবাদে। একজন এশিয়ান মুসলিম হিসেবে এই শহরে তার যে অভিজ্ঞতা তা থেকে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেন, বৈষম্যকে একদিন পরাজিত করবেন।
হাবিবুর রহমানের বয়স ৪৭ বছর। নিজের নিয়োগ নিয়ে তিনি বলেছেন, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তগুলোর একটি। এ সময়ে তিনি তার দায়িত্বকে ব্যবহার করে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা এবং সমতাকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিন সন্তানের পিতা হাবিবুর বলেন, এভাবেই ইতিহাস নির্মিত হয়। এই ইতিহাস আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। তা সত্ত্বেও এই দায়িত্ব নিয়ে এই শহরকে সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি এবং লিঙ্গের মানুষদের জন্য অবাধ ও উন্মুক্ত করণ নিশ্চিত করতে হবে। আমি এটা অনুমোদন করবো। আমি ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ এবং যেকোনো রকম বর্ণবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাই এবং নিন্দা জানাই। ১২১৬ সালে নিকোলাসের ছেলে ডানিয়েলের পর থেকে মেয়র পেয়েছেন নিউক্যাসেলবাসী। কিন্তু ১৯০৬ সালের আগে সেখানে লর্ড মেয়রের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ওই সময় ষষ্ঠ কিং এডওয়ার্ড একটি ডিক্রি জারি করে এই পদ সৃষ্টি করেন।
কেন দায়িত্ব গ্রহণের বক্তব্যে সরাসরি নিজের পিতাকে নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান বলেছেন, আমি বলতে চেয়েছি যে, তাকে আমরা সবাই খুব মিস করছি। তার কাছে আমরা এই বার্তা দিতে চাই যে, তিনি ১৯৭৭ সালে যে বর্ণবাদী শহর দেখেছিলেন, নিউক্যাসেল এখন আর তেমন নেই। এখন এ শহর নিরাপদ। সহিষ্ণু। এই ধারা গড়ে তুলেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি। সম্ভবত তার অনেকটা শুরু হয়েছে আমার পিতার মৃত্যুর পর। আমি আমার পিতাকে বলতে চাই যে, আমাদেরকে নিয়ে তার এখন ভীত হওয়ার কিছু নেই। তিনি যখন এই শহর ছেড়ে গেছেন, এই শহর এখন তার চেয়ে অনেক উন্নত।
বর্ণবাদ বিরোধী গ্রুপ শো রেসিজম দ্য রেড কার্ড (এসআরটিআরসি) এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হাবিবুর রহমান। বুধবার তার দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের সাবেক তারকা ও এসআরটিআরসির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জন বেরেসফোর্ড। তিনি বলেছেন, ১৯৯৮ সাল থেকে এসআরটিআরসির একজন ব্যতিক্রমী সমর্থন হাবিবুর রহমান। বৃটেনে বর্ণবাদ বিরোধী শিক্ষা বিষয়ক দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। নিউ ক্যাসেলের লর্ড মেয়র হিসেবে তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকে পাশে রেখে আমরা অর্থসংগ্রহের নতুন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেবো। তা নিয়ে আলোচনা হবে।
এসআরটিআরসির প্রেসিডেন্ট শাকা হিসলোপ বলেছেন, হাবিবুর রহমানের রাজনীতিতে উত্থান দেখে বাস্তবেই গর্ব বোধ হচ্ছে। যারা খুব অভাবে তাদেরকে সমর্থনে হাবিব সমসময়ই এগিয়ে গেছেন। শো রেসিজম দ্য রেড কার্ড উদ্যোগে কাজের মাধ্যমে আমি হাবিবকে চিনতে পেরেছি। আর সেই সুবাদে এই ইতিহাস রচনা হতে দেখছি। এই শহরের প্রতি আমাদের সবার ভালবাসা আছে। সম্মান আছে।
লেবার দলের কাউন্সিলর ইরিম আলি নিউক্যাসেল নিয়ে অসীম শ্রদ্ধা ও আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনিই আনুষ্ঠানিকভাবে লর্ড মেয়র হিসেবে হাবিবুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। শহরের লেবার নেতা এবং কাউন্সিলর নিক ফোরবিস বলেছেন, হাবিবুর রহমানকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে নিউক্যাসেল এবং আমাদের মূল্যবোধের বিষয়ে শক্তিশালী বার্তা দেয়া হয়েছে। প্রচলিত মেয়রাল চেইনে এখন আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের একত্রিত করছি। আমরা তাদেরকে বন্ধুত্বের এবং গর্বের বন্ধনে একত্রিত করছি।
উল্লেখ্য, এখন শেরিফ ও ডেপুটি মেয়রের দায়িত্ব যাবে দীর্ঘদিনের লিবারেল ডেমোক্রেট দলের কাউন্সিলর অনীতা লোয়ারের হাতে।