ব্রেকিং নিউজ
Home / নির্বাচিত কলাম / মহানবীর বর্ণবাদহীন সমাজ আজো বিশ্ববাসীর জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

মহানবীর বর্ণবাদহীন সমাজ আজো বিশ্ববাসীর জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

ব্যারিস্টার নাজির আহমদ :: বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দায়সারা বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়ে বসে থাকা বা দায়িত্ব পালন করা এক জিনিস আর বক্তৃতা ও বিবৃতির সাথে সাথে সমাজে তা বাস্তবে প্রতিস্টিত করা সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস। বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রিয় নবী (সা:) শুধু বলে বা বিবৃতি দিয়েই চলে যাননি বরং বর্ণবাদহীন ও বর্ণবৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।

আটলান্টিকের দু’পার, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বর্ণবাদবিরোধী এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে টালমাটাল। উন্নতির চরম শিখরে উঠেও বিশ্বের পরাশক্তির দাবীদার আজ বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যে যেন কাতর। আটলান্টিকের এপারে বর্ণবাদ যে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করেছে মেকপিয়ারসন বেশ কয়েক বছর আগে তা তার রিপোর্ট বলে গেছেন। আর আটলান্টিকের ওপারে শেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হাঁটুর নীচে কৃষ্ণাঙ্গ নিরপরাধ জর্জ ফ্লয়েড শ্বাসরোধ্য হয়ে জীবন দিয়ে বিশ্ববাসীকে আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারনা দিয়ে গেছেন। অথচ ১৪০০ বছর পূর্বে মুহাম্মদ (সা:) আরবের মরুপ্রান্তরে বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের মত বিষয়গুলোর কি চমৎকার ও বাস্তব সমাধান করে গেছেন!

ইসলামে বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের কোন স্থান নেই। সাদা-কালোয়, ধনী-গরীবে, উঁচু-নীচুতে কোনো তারতম্য কিংবা শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্টের পার্থক্য করেনি ইসলাম এবং এগুলো ভালোমন্দের কোনো মানদণ্ডও নয়। মহান মা’বুদ পবিত্র কোরআনে ঘোষনা করেন “হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার (তাকওয়ার অধিকারী) সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।” (সুরা হুজুরাত: ১৩)।

বিভিন্ন আকৃতি ও বর্ণে মানুষ সৃষ্টি করা মহান আল্লাহপকের সৃষ্টির বৈচিত্রতা (Diversity)। তিনি বলেন, “আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা রূম: ২২)। সৃষ্টির এই বৈচিত্রতাতে আছে জ্ঞানীদের জন্য প্রচ্ছন্ন নিদর্শন। এই বৈচিত্রতা ও ভিন্নতা চিনার ও অনুধাবন করার জন্য, বৈষম্যের জন্য নয়। মহান মাবুদও পরকালে এই বৈচিত্রতা ও ভিন্নতার ভিত্তিতে পার্থক্য করবেন না। বরং পার্থক্য ও মর্যাদার ভিত্তি হবে কেবল মাত্র তাকওয়া। আমাদের প্রিয় নবী (সা:) বলেন: “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন ৷” (সহীহ মুসলিম: ২৫৬৪)।

৬৩২ ইংরেজীতে বিদায় হজ্জ্বের ভাষনে প্রিয় নবী (সা:) বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলে গিয়েছেন। তাঁর ঐ গুরুত্বপূর্ণ ভাষনে অন্যান্য বিষয়ের সাথে তিনি বলেন, “কোন অনারবের উপর কোন আরবের, কোন আরবের উপর কোন অনারবের উচ্চ মর্যাদা নেই…….একজন শেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গের তুলনায় এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ একজন শেতাঙ্গের তুলনায় উচ্চতর নয়। পার্থক্য ও মর্যাদার ভিত্তি হলো কেবল তাকওয়া।”

প্রিয় নবী (সা:)- এর বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বলিষ্ট অবস্থানের দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই হযরত বিলাল ইবনে রাবাহ (রা:) এর সাথে তাঁর সম্পর্কে। হযরত বিলাল (রা:) ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাস, যিনি পরবর্তীতে হযরত আবু বকর (রা:) এর হাতে দাসত্ব থেকে মুক্ত হন। অথচ মদীনায় মসজিদে নববীতে মুহাম্মদ (সা:) তাঁকে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে নিযুক্ত করেন।

বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বনবী (সা:) জিরো টলারেন্স দেখিয়েছেন। একবার বিশিষ্ট ও নবীর (সা:)-এর ঘনিষ্ট সাহাবী (যিনি ইসলামের একেবারে প্রথম দিকে ঈমান আনয়নকারী সাহাবী) হযরত আবু যর গিফারী (রা:) তর্কের সময় বিলাল (রা:) কে “কালো মায়ের সন্তান” বলে গালমন্দ করলে রাসূল (সা:) এতে বিরক্ত হন। তিনি তখন আবু যর গিফারীকে (রা:) বলেন, “তুমি এমন ব্যক্তি, যার মধ্যে এখনো জাহেলিয়াতের চিহ্ন রয়েছে”। অত্যন্ত ঘনিষ্ট সাহাবী হওয়ার পরও রাসূল (সা:) এখানে হযরত আবু যর গিফারী (রা:)-এর বক্তব্যকে ‘জাহিলিয়াতের’ (দ্বীনের আলো আসার আগের অন্ধকার যুগ) সাথে তুলনা করেছেন।

অপরদিকে একবার মসজিদে নববীতে হযরত উমর (রা:)- এর মুখ থেকে বের হয়ে পড়লো, “বেলাল! তুমি কালো এক হাবশী।” এ কথা শুনে নবী (সা:) বললেন, “এখনো তোমাদের মধ্যে জাহিলিয়্যাতের অন্ধ আভিজাত্যের গন্ধ রয়ে গেছে।” হযরত উমর (রা:) এ কথা শুনে অনুশোচনায় মাটিতে নুয়ে পড়লেন। উঠতে বলা হলে বললেন, বেলাল আমাকে পা দিয়ে তোলে না দেয়া পর্যন্ত আমি উঠবো না। শেষে তিনি সত্যিই বেলালকে বাধ্য করলেন, পা দিয়ে উঠিয়ে দিতে। পরবর্তীতে হযরত উমর (রা:) হযরত বেলাল (রা:)’কে আসতে দেখলে উঠে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, “আবু বকর (রা:) আমাদের সরদার ছিলেন এবং তিনি আমাদের নেতা বেলাল (রা:) কে আযাদ করেছেন”।

উপরের কোরআনের আয়াত (সুরা হুজুরাত: ১৩) ও বিদায় হজ্জের ভাষন থেকে স্পষ্ট যে মানুষে মানুষে পার্থক্য ও মর্যাদার ভিত্তি হলো কেবল তাকওয়া বা পরহেজগারী। চিন্তা করুন – এক সময়ের কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাস বিলাল (রা:) মুসলমান হয়ে শুধু মাত্র ঈমান ও তাকওয়ার কারনে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন! রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমি মেরাজে জান্নাতের মধ্যে বেলালের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছি।”

ইসলামের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে করবে।” (সুরা নিসা: ৫৮)। অন্যত্র আল্লাহপাক বলেছেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দেন।” (সুরা নাহল: ৯০)। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কিংবা সাদা-কালোর তারতম্য করার সুযোগ নেই। অথচ বর্তমান পৃথিবীতে, বিশেষ করে আটলান্টিকের ওপারে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছার দাবীদার যারা মানবাধিকার বলে চিৎকার করে বেড়ায়, সেখানেও দেখা যায় সাদারা ন্যায়বিচার পেলেও কালোরা তা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্য – সাদা-কালোয় পার্থক্যকরণ। পরিতাপের বিষয় যে উন্নতির চরম পর্য়ায়ে পৌঁছে ও পরাশক্তি হয়েও কৃষাঙ্গ ও শেতাঙ্গ হওয়াকে উচুতা এবং নিচুতার মানদন্ড বিবেচনা করা হয়। আফসুস্। চৌদ্দশত বছর আগে প্রিয় নবী তাঁর বলনে, চলনে ও সর্বোপরি বাস্তবে যে বর্ণবাদহীন এবং বর্ণবৈষম্যবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা আজও বিশ্ববাসীর জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং থাকবেও চিরকাল অনুকরনীয় সর্বাধুনিক নমুনা হিসেবে।

লেখক: বৃটেনের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গবেষক ও চিন্তাবিদ।