ব্যারিস্টার নাজির আহমদ :: চীন-ভারত সীমান্তে টান-টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুরোপুরি যুদ্ধ (অল আউট ওয়ার) লাগার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চীন স্ট্যাডিলী বাট এগ্রেসিভলী আগাচ্ছে। চীনের প্রচ্ছন্ন আশকারা পেয়ে প্রায় বাংলাদেশের আয়তনের নেপালও ভারতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। মাত্র ১৫,০০০ বর্গমাইলের অনেকটা ক্ষুদ্র রাস্ট্র ভূটানও ভারতের বিরুদ্ধে সাহস দেখাতে পিছিয়ে নেই! ভারতীয় মিডিয়ার খবরগুলো দেখলে বা পড়লে এক ধরনের আবেগী চিত্র দেখা যায়। কিন্তু চীনের বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া দেখলে বা পড়লে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। ভারতীয় মিডিয়ার খবরগুলো দেখলে মনে হয় – এই যেন ভারত প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে, চীনকে কড়া জবাব দিতে জওয়ান ও বায়ুসেনা প্রস্তুত! আসলে কি তাই?
নিরপেক্ষভাবে ভূ-রাজনীতির পর্যবেক্ষনে দেখা যায় – চীনের সাথে যুদ্ধে ভারত কোনভাবেই পেরে উঠবে না। চীন বিশ্বের একটি অন্যতম বৃহৎ সুপার পাওয়ার – তারা আমেরিকাকে শক্তি ও অর্থনীতি উভয় দিক দিয়ে টক্কর দেয়ার চিন্তায়। সৈন্য, লোকবল ও অস্ত্রে চীনের শক্তি ভারতের প্রায় দ্বিগুন বা তারও বেশী। প্রযুক্তি ও রিসোর্সে অনেক এগিয়ে – সপ্তাহের মধ্যে ৪০০০ বেডের হাসপাতাল তৈরী করতে সক্ষম! তাছাড়া চীন অর্থনীতিতে বিশ্বে জায়েন্ট। ভারতের অর্থনীতি তুলনামুলকভাবে খুব দুর্বল। প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে। এখনও কোটি কোটি মানুষ খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয়! এমতাবস্থায় একটি সুপার পাওয়ারের সাথে যুদ্ধে ভারত কতটুকু ঠিকে থাকতে পারবে এটা একটা বড় প্রশ্ন। এটা আবেগে ভাসমান ভারতীয় মিডিয়া না বুঝতে পারলেও মোদিজি (মোদি সাহেব) ভাল করেই বুঝেন। আর বুঝেন বলেই দৃশ্যত এত ক্ষতি হওয়ার পরও চীনের বিরুদ্ধে শুধু তর্জন-গর্জন ও ফাঁকা বুলির মধ্যেই তার প্রতিশোধ নেয়ার বা জবাব দেয়ার তত্পরতা সীমাবদ্ধ রাখছেন। আজ এ ক্ষতি যদি পাকিস্তান করতো? অথবা ভারত যদি চীনের এই ক্ষতি করতো? কি প্রতিক্রিয়া যে হতো বা কি প্রতিশোধ যে নেয়া হতো তা সহজেই অনুমেয়! কেউ না বুঝলেও ভারতীয় জেনারেলরা ভাল করেই বুঝেন যে – চীনের বিরুদ্ধে তথাকথিত সার্জিক্যাল অপারেশনের (যা তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চালিয়েছেন বলে বলে থাকেন) মতো কোন অপারেশন চালালে চীন ভারতের বিরোধপূর্ন হাজার হাজার বর্গমাইলের পূরো এলাকা দখল করে নিবে।
গোটা দক্ষিন এশিয়ায় খুব কমই ভারতের প্রকৃত বন্ধু রাস্ট্র আছে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে যদি তার সব প্রতিবেশীদের সাথে সুবিচার করতো, তাদেরকে সঠিক মর্যাদা দিতো এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার/হিস্যা দিয়ে আসতো তাহলে তার বিপদের সময় সেসব দেশগুলো তার পাশেই থাকতো। পাকিস্তান ভারতের চিরশত্রু (arch-rival ), নেপাল বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে, ভূটানও মেরুদন্ড খাড়া করার আলামত দেখাচ্ছে। যুদ্ধ বাধলে এদেশগুলো যে চীনের পক্ষেই যাবে তা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয় এই অন্চলের চলমান ভূ-রাজনীতির পরিপেক্ষিতে চীনের প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিতে পাকিস্তান যদি হাজার মাইল দুরে ভারতের অন্য ফ্রন্টে আক্রমন করে বসে তাতে কেউ আশ্চর্য হবে না। যে যাই বলুক দুই ফ্রন্টে দুই পারমানবিক শক্তিধর (যারা যথাক্রমে বিশ্ব ও আন্চলিক পরাশক্তিও বটে) দেশের সাথে যুদ্ধ করার অবস্থায় নেই ভারত। ভৌগলিকভাবে ভারতের অবস্থান অনেকটা নাজুক। বাকী থাকলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ বিভিন্ন কারনে ভারত বিরোধী। এমতাবস্থায় নিজের দেশের বিপুল জনসংখ্যা ও পরাশক্তিসম বৃহৎ উন্নয়ন পার্টনারের বিরুদ্ধে গিয়ে যুদ্ধে ভারতের পক্ষে দাঁড়ানো বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে খুব কঠিন হবে।
সাধারণভাবে দক্ষিন এশিয়া এবং বিশেষ করে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য ভারতের বিদেশ নীতি বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সাথে তার সম্পর্ক ও নীতি বহুলাংশে দায়ী। আন্চলিক পরাশক্তি হতে হলে মনকে বড় করতে হয়, হতে হয় উদার। নিজের জন্য যা ন্যায্যতা চাইতে পারেন তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু অন্যের ন্যায্যতা ও সমতা পাবার স্পৃহা এবং আকাঙ্খা বুঝতে হবে। এজন্যইতো আন্তর্জাতিক আইনে ও সম্পর্কে “ন্যায্যতা” ও “সমতা” ও “আনুপাতিক হারে পাপ্যতা” গুরুত্বপূর্ণ কিছু কনসেপ্ট। ভারতের সত্যিই এ ব্যাপারগুলো নিয়ে সোল-সার্চিং করা দরকার।
ভারত যদি মনে করে চীনের সাথে পুরোদমে যুদ্ধ বাঁধলে অন্যান্য সুপার পাওয়ার যথা আমেরিকা বা রাশিয়া তাদের পিচনে লাইন ধরে খাড়া হবে এবং যুদ্ধ করবে তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন রাস্ট্রগুলো কোন দিনই এক রাস্ট্র অপর রাস্ট্রের সরাসরি বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না বা যুদ্ধ করবে না। এমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অলিখিত নিয়ম হয়ে আসছে। ভেটো দেয়ার ক্ষমতা এক মারাত্মক অস্ত্র যা দিয়ে এক সদস্য অন্য সদস্য রাস্ট্রের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার উচ্চবিলাসকে লাগাম ধরে রাখতে পারে। তাই তারা কোনভাবেই ঐ পর্য়ায়ে যাবে না। তাছাড়া মোটামুটি শক্তিধর রাস্ট্রের সাথেও সরাসরি সম্মোখ যুদ্ধে পরাশক্তি কোন দিন উপনিত হয় না বা হবে না। উদাহরণস্বরূপ – নর্থ কোরিয়া সুপার পাওয়ার আমেরিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখালেও আমেরিকা “টাগ অব ওয়ারে” সীমাবদ্ধ থাকাকেই নিরাপদ মনে করেছে! কিউবার মিসাইল ক্রাইসিসের সময় দুটি পারমানবিক শক্তিধর পরাশক্তি মুখামুখি যুদ্ধ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল কিন্তু তারা নিজেরাই পরিনাম দেখে তারা নিজ থেকে সরে এসেছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সুন্দর অবস্থানে আছে। সংবিধানিক স্পিরিট বজায় রেখে কোন পক্ষের দিকে অবস্থান না নিয়ে বা বিবৃতি না দিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সঠিক কাজ করেছে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ। অন্য দেশ বা রাস্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের পলিসি হচ্ছে “সবার সাথে বন্ধুত্ব”। পররাস্ট্র নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে স্পস্ট করে লিখা আছে “…অন্য রাস্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি হবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব (national sovereignty), আভ্যন্তরীন বিষয়ে নাগ না গলানো (non-interference in internal affairs) ও সমতা (equality)…….। ভারত আমাদের নিকটতম ও বড় প্রতিবেশী। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, মুক্তিযুদ্ধে তারা সরারসরি আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে। অনেক কিছু পরিবর্তন করা গেলেও প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না। অপরদিকে চীন আমাদের বৃহৎ উন্নয়ন পার্টনার ও আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনেকটা চাবিকাঠি। সুতরাং বাংলাদেশকে চলতে হবে ভারসাম্য রক্ষা করে, ভূ-রাজনীতির বাস্তবতাকে মাথায় রেখে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। ধীশক্তি ও প্রজ্ঞার পরিবর্তে আবেগতাড়িত হয়ে কোন কিছু করলে বা সিদ্ধান্ত নিলে তার চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
আমরা যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তি। যুদ্ধ কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। চীন-ভারতের পুরোপুরি যুদ্ধ পূরো দক্ষিন এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলবে যা নি:সন্দেহে গোটা বিশ্বে প্রভাব ফেলবে। তাই আমরা চাই চীন-ভারতের বিরোধপূর্ন বিষয়গুলো কুটনৈতিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান হোক।
লেখক: বৃটেনের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গবেষক ও বিশ্লেষক।