আরপিও সংশোধনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ‘নোট অব ডিসেন্ট’, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘ফোরাম অব ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বডিস অব সাউথ এশিয়া’ (ফেমবোসা) নবম সম্মেলনসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা গেছে। জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে পাঁচ সদস্যের এই কমিশনে বিভক্তিও বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে, অথচ নির্বাচন কমিশনারদের সবাই সেসব বিষয়ে অবগত নন। কমিশনারদের না জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পরামর্শে কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ করছেন ইসি সচিব। সাম্প্রতিক এমন কয়েকটি ঘটনায় ক্ষুব্ধ চার কমিশনার সচিবকে আনঅফিসিয়াল নোট (ইউও নোট) লিখে কমিশনের ঘটনাবলি জানাতে বলেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনারদের এমন নোটের ফলে ইসির কার্যক্রমে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। কমিশন ও সচিবালয়ের দ্বন্দ্বে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সবাই মিলে ইসি সচিবের কাছে কিছু তথ্য চেয়েছি। ইভিএম কতটি করা হয়েছে, আরো কতটি কী প্রকল্প করা হয়েছেÑ এমন অনেক বিষয় আমরা গণমাধ্যমে দেখি। কিন্তু নিজেরা এসব বিষয়ে কোনো তথ্য জানি না। এ জন্য বেশ কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করিবে এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক উহার উপর আরোপিত অন্যান্য যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করিবে।’ আইনে আরো বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিকট দায়ী থাকিবেন।’
ইসি সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, পূর্বে কমিশনাররা মিলে কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতেন এবং সচিবালয়ের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হতো। বর্তমান কমিশনে পুরো উল্টো ঘটনা ঘটছে। সচিবালয় থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু কমিশনাররা তা জানছেন না। কমিশনারদের বাদ দিয়ে এভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ চলতে থাকলে সামনে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা কর্মকর্তাদের। সম্প্রতি ৩৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপনের আগে এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না চার কমিশনার। এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ নিয়েও অন্ধকারে রয়েছেন চার কমিশনার। কমিশনারদের সাথে আলোচনা ছাড়াই ভোটের তারিখ নিয়ে সচিব গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন। এ নিয়েও ক্ষুব্ধ কমিশনাররা। গত ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফেমবোসা সম্মেলন শুরু হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনারদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অনুষ্ঠান কিভাবে হবে তাও তাদের জানানো হয়নি। সম্মেলন সিইসি ও সচিবের পরিকল্পনা অনুসারে হয়েছে।
এদিকে গত ২২ সেপ্টেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিণ শুরু হয়েছে। এ বিষয়েও চার কমিশনারের মতামত নেয়া হয়নি। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিলেন কেবল সিইসি ও সচিব। চার কমিশনারের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। এ প্রশিণ বিষয়ে তাদের মতামত গ্রহণ এবং এমনকি আমন্ত্রণও জানানো হয়নি বলে জানা গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিইসি ইতোমধ্যে নির্বাচনী সফর শুরু করেছেন। ইসি সচিবেরও সফরের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখনো চার নির্বাচন কমিশনারের সফরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। এভাবে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে দূরত্ব বাড়ছে কমিশনারদের।
ইসি সূত্র জানায়, আগে কমিশন সভা ছাড়াও অন্য দিনগুলোয় সব কমিশনার সিইসির কার্যালয়ে চা খেতে বসতেন। সম্প্রতি তারা প্রয়োজন ছাড়া সেখানে যাচ্ছেন না। চার কমিশনার মিলে একেক দিন একেক কমিশনারের রুমে বসেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, কমিশনাররা একটি নোট দিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, নির্বাচন কার্যক্রম সম্পর্কে যেন তাদের জানানো হয়। নির্বাচনী কার্যক্রম বিষয়ে যেন তাদের জানানোর জন্য ফাইল উঠানো হয়। চার কমিশনার মিলে ওই নোট দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। এর আগে গত বছরের ১১ জুলাই ইসি সচিবালয়ের বদলি ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে ইউও নোট দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ওই সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন কমিশনের তৎকালীন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।