বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত অস্ত্র ঠেকিয়ে দুই বান্ধবীকে আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগ বিদায়ী ২০১৭ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। এ ঘটনার ৩৯ দিন পর বনানী থানায় মামলা করতে গেলে প্রথম দফায় ভুক্তভোগী ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। কারণ ধর্ষকেরা ক্ষমতাসীন। পরের দিন সন্ধ্যায় মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হলে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশে বনানী থানায় মামলা গ্রহণ করা হয়।
একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছেই। ধর্ষণের দৌড়ে মনে হচ্ছে ভারতকেও পেছনে ফেলে দেবে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর ধরেই এ ধারা অব্যাহত। বিশেষ করে আওয়ামী শাসনামলে ধর্ষণের বিষবাষ্প সমাজে ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছে। নারী-শিশু- বৃদ্ধা কেউ বাদ পড়ছে না ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে। দেশের একাধিকস্থানে ধর্ষণের বিভৎসতার খবর নাড়া দিয়ে বেকায়দায় ফেলেছে সরকারসহ আইনশৃংখলাবাহিনীকে। কারণ ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনার সাথে জড়িত ক্ষমতাসীনরা।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায় ২০১৩ সালে সারাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছিল ৩৬৫০টি। পরের বছর মামলা সংখ্যা আরও ৪৫টি বেড়ে হয় ৩৬৯৫টি। ২০১৫ সালে ধর্ষণের মামলা আরও বেড়ে হয় ৩৯৩০টি। ২০১৬ সালে এটা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৭২৮টি। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৯৫ টি। আর ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৫৯২ টি অর্থাৎ দিনে প্রায় ১২ টি ধর্ষণের মামলা হচ্ছে দেশে। দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছেই। শেখ হাসিনা সরকারের ২য় মেয়াদে বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২১৫৯০ টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খুনসহ অন্যান্য বেশ কিছু অপরাধ তুলনামূলক কম হলেও ধর্ষণ এবং মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাড়ছে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও। নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলা যা দেখা গিয়েছে তার চাইতেও বেশি ঘটনা ঘটে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলরুবা শারমিন বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় দিনে সাড়ে একুশ হাজার মামলা হলেও ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি। কারণ, মানুষ মামলা করতে চায় না সামাজিক দিক চিন্তা করে। কারণ জানাজানি হলে বিয়েতে সমস্যা হবে অনেকের ক্ষেত্রেই।’ ‘আবার থানা পুলিশ-কোর্ট কাচারিতেও হয়রানির শিকার হয় মানুষ। নোংরা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাদের।’
মানবাধিকার কর্মী ফারজানা আফরোজের মতে গত পাঁচ বছরে ধর্ষণের ঘটনা ৫০০০০ হাজারেরও বেশি। দিলরুবা শারমিন বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় বলে আবার অনেকেই মামলা করতে উৎসাহী হয় না। এমন উদাহরণও আছে যে একটি ধর্ষণ মামলার বিচার গত ১৬ বছরেও হয়নি। তাই মামলার দিকে যেতে চায় না অনেকেই।’ ‘আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা না নিয়ে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করে। ফলে পুলিশ নিজেও মামলা না নিয়ে সংখ্যা কম দেখাতে চেষ্টা করে।’
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ ধর্ষণের সাথে জড়িত আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো। অনুসন্ধানে অনেকগুলো ঘটনা এমন পাওয়া গিয়েছে ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় এসেছে কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি ক্ষমতাসীনদের চাপে। বিশেষ করে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে একচেটিয়া ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। শহরাঞ্চলের বাইরে মফস্বলগুলোতে এবং উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে নারীরা ধর্ষণ, শ্লীলতাহানী ও ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে অহরহ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নরসিংদী সরকারি কলেজের এক ছাত্রী আমাদের জানিয়েছেন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের কারণে তার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ক্লাস করছেন না অনেকদিন থেকে। শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেও কোন ফল হয়নি। আরেক ছাত্রী আসমা জানিয়েছেন শিক্ষকরা নিজেই অসহায়। ছাত্রলীগের কথায় তারা কলেজ পরিচালনা করেন।
শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার ও তার আত্মীয়দের হাতে নির্যাতিত অসহায় মা ও মেয়ে
বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের নেতা তুফান সরকার এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর মা ও ভুক্তভোগী মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনাও কাঁপিয়েছে সারা দেশ। তুফান সরকার ও তার সহযোগীরা এসএসসি পাস এক ছাত্রীকে ভালো কলেজে ভর্তি করার কথা বলে গত বছরের ১৭ জুলাই শহরের নামাজগড় এলাকায় তাদের বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে এ ঘটনা কাউকে না জানাতে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ধর্ষণের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা ও তার বড় বোন বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তার রুমকিসহ কয়েকজন মিলে ওই ছাত্রী ও তার মাকে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দেন।
খাদিজাকে কোপাচ্ছে বদরুল
প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল। ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থীরা তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। খাদিজাকে কোপানোর লোমহর্ষক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। এই ঘটনাও বেশ আলোচিত ঘটনা। এই ঘটনার আগেও খাদিজাকে নানানভাবে উত্যক্ত করে আসছিলো বদরুল। তেমনি একটি ঘটনায় এলাকাবাসী বদরুলকে গণধোলাই দেয়। সেসময় ছাত্রলীগ প্রচার করে বদরুলকে শিবির রাজনৈতিক কারণে পিটিয়েছে। এই নিয়ে অনেক শিবির কর্মীকে জেলেও যেতে হয়েছে।
অ্যানালাইসিস বিডির সাথে আলাপচারিতায় কলামিস্ট ও সমাজচিন্তক জুলফিকার হায়দার বলেন, মূলত চারটি বিষয় এই ধর্ষণের ঘটনার পেছনে দায়ী। প্রথমটি হলো- অপসংস্কৃতির সয়লাব, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই। অতি সহজে যৌন ছবি, উত্তেজক ভিডিও পাওয়া যায়। ফলে ধর্ষণের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- ধর্মীয় মূল্যবোধের ঘাটতি। পুঁজিবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যকার যে অস্থিরতা, মানুষের মধ্যকার যে দূরত্ব, মানুষের প্রতি পারস্পারিক সম্মানবোধ, লিঙ্গভেদে মানুষের প্রতি যে সহনশীল আচরণ- তা অনেকটাই কমে গেছে। আর একইসঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আর তৃতীয়টি হলো- বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে এক প্রকার শিথিলতা আমরা লক্ষ্য করি। এটা থেকে বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ধর্ষণের দ্রুত বিচার যখন না হয়, তখন এটি আরও একটি ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। চতুর্থটি হলো- ধর্ষণে ক্ষমতাসীনদের অংশগ্রহন। যেসব ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষমতাসীনরা জড়িত সেসব ঘটনার বিচার তো দূরের কথা সেগুলোর মামলাও নেয়া হয় না। এই সকল বিষয়গুলো যদি সরকার বা রাষ্ট্র মাথায় রেখে কাজ করে, তবে ধর্ষণের ঘটনা অনেকটা কমে যেতে পারে।
বিগত পাঁচ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার পরিসংখ্যান
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাদেরকে রক্ষা করবে, তারা যেন আইনের ভিত্তিতেই অধিকার প্রয়োগ করে। কিন্তু আমরা দেখি যে, এই ক্ষেত্রে অনেকটা শিথিলতা দেখা যায়। এই সমস্ত বিষয়ে সমাজের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, প্রশাসন এবং পুলিশ অনেক সময় এই ঘটনাগুলোকে সমঝোতা করতে বলে বা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। একটি ধর্ষণের ঘটনা এমন এড়িয়ে যাওয়ার মানে হলো আরেকটি ঘটনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়তা করা। আর এই কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হলো এমন ঘটনার সাথে সাথেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ এক্ষেত্রে সরকারই পারে সঠিক ভূমিকা রাখতে কিন্তু যখন সরকার নিজেই ধর্ষকের ভূমিকায় থাকে তখন দেশের কী হবে? আমরা এখন সেই পর্যায়ে আছি।
ধর্ষণের পাশাপাশি নারীদের শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং, শিশু নির্যাতনও বাড়ছে দিন দিন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১ লক্ষ ৭৪২৬ টি। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ১৭৫৫২টি, ২০১৪ সালে ২০৯৯৮টি, ২০১৫ সালে ২২২২০টি, ২০১৬ সালে ১৮৪৪৬টি, ২০১৭ সালে ১৭০৭৩টি, ২০১৮ সালে ১০৯৩৭টি মামলা হয়েছে।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলছিলেন, যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো বেশির ভাগ আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তার এই দাবীর সাথে একমত নন মানবাধিকার ও নারী অধিকার কর্মীরা। শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস সহিদ মাহমুদ জানান, বাংলাদেশে শিশু নিরাপত্তার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে। আর তা দিন দিন বাড়ছে। বেশির ভাগ ঘটনায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচার হলেও রায় কার্যকর না হওয়া বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি তো এত খারাপ হওয়ার কথা নয়।