২০ মার্চ ২০১৬: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘একজন মানুষ যতবড় ক্ষমতাধরই হোন না কেন আইন সোজা পথে চলে, আঁকাবাকা চলে না। অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যেকোনো আদেশ দিতে সংকোচ বোধ করব না।’
আজ রোববার খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের আদালত অবমাননার রুলের শুনানিতে এ মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।
সকাল সোয়া ৯টায় আদালত অবমাননার শুনানি শুরু হলে দুই মন্ত্রী আদালতে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় আ ক ম মোজাম্মেল হকের পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বসার অনুমতি চাইলে আদালত তাঁকে বসার অনুমতি দেন।
অন্যদিকে কামরুল ইসলামের পক্ষে অ্যাডভোকেট বাসেত মজুমদার বসার অনুমতি চাইলে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনাদের তো কোনো জবাব পাইনি।’
জবাবে বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা জবাব দিয়েছিলাম।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জবাবে আপনারা কী বলেছেন, পড়েন।’
এ সময় বাসেত মজুদমার খাদ্যমন্ত্রীর জন্য আবারও বসার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেন আদালত।
বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা ভুল করেছি। নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকব বলে অঙ্গীকার করছি। আদালত এবং বিচারপতিদের প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান রয়েছে। আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এ জন্য আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ওই সময় আমি দেশের বাইরে, নেপালে ছিলাম। আমি হাইকমিশনারের ফোন থেকে আইনমন্ত্রীকে ফোন দিয়ে বলেছি, দুইজন মন্ত্রী যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়টি যেন কেবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয় এবং দুই মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করেই যেন নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চান। ক্ষমা না চাইলে পরিণতি খারাপ হবে। এরপর আমি বিমানবন্দর থেকে বাসায় না গিয়ে সরাসরি কোর্টে এসেছি। এ সময় আপিল বিভাগের সব বিচারপতি বিষয়টি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেছেন। আমি আইনমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, কেবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বকাঝকা করেছেন। জবাবে আমি বলেছি, বকাঝকায় কাজ হবে না, নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। চুল পরিমাণও যেন বরখেলাপ না হয়। পরের দিন মীর কাসেম আলীর গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেব। রায়ের আগের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত বিচারপতিদের নিয়ে মিটিং করেছি আমরা। সেখানে আইনমন্ত্রী আসলেন। বিচারকদের সাথে কথা বললেন না।’
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘আদালত সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। আপনারা মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। আপনারা যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তাতে প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি, বরং বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে পদদলিত করেছেন। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিলেও অন্যদেরকে তো তিনি কিনতে পারবেন না। রায় তো প্রধান বিচারপতি একা দেন না।’
এ সময় দুই মন্ত্রীর আইনজীবীকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা কী জনকণ্ঠের আদালত অবমাননার রায় পড়েছেন? সেখানে আমরা আদালত অবমাননার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি।’
কামরুল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কী কাসেম আলীর রায়কে প্রভাবিত করার জন্যই এ মন্তব্য করেছেন?’
এরপর বাসেত মজুমদারকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সঠিক হয়নি। পড়াশোনা করে আসবেন। ব্যাখ্যার পাঁচ নম্বর প্যারাতে সাংঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে। আপনি জানেন সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না।’
এ সময় আ ক ম মোজাম্মেল হকের আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘সংবিধান এবং আদালত মানতে সবাই বাধ্য।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কুৎসা রটনা, বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ এগুলো ফৌজদারি অপরাধ। ডাকাতি মামলার আসামিকে যে সাজা দেওয়া হয় আদালত অবমাননাকারীকেও একইভাবে সাজা দেওয়া হয়। মন্ত্রী হিসেবে আপনারা শপথ নিয়েছেন। আবার টক শোতে যাবেন, বিচার বিভাগ নিয়ে সমালোচনা করবেন- এটা হতে দেওয়া যাবে না। শপথ নিয়ে সংবিধান ভঙ্গ করলে এর পরিণতি কী হবে তা ভেবে দেখেছেন? দেশ তো চলতে হবে। সংবিধান রক্ষা করতে হবে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সংবিধানের চুল পরিমাণও ব্যত্যয় ঘটাতে পারি না। একজন সাধারণ নাগরিক আর দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার বিষয়টি এক নয়।’
এ সময় রফিক-উল হককে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো আসামিকে অভিযোগ গঠনের পূর্বে আদালতের এজলাসে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় দোষী না নির্দোষ। তখন আসামি যদি দোষ স্বীকার করে তখন আদালত কী করেন? ’
জবাবে রফিক-উল হক বলেন, ‘তখন আদালত তাঁকে লঘুদণ্ড দিতে পারেন। তবে এখানে আমরা অন্যায় করেছি, মাফ চেয়েছি। এখন পুরো বিষয়টিই আদালতের ওপর নির্ভর করছে।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রধান বিচারপতি যদি মীর কাসেম আলীর মামলা থেকে অবসরে চলে যেতেন, তাহলে দেশে দাঙ্গা লেগে যেত। যুদ্ধাপরাধের মামলা বানচাল হয়ে যেত। আমরা জানি দেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা এবং তারা কে কী অবদান রেখেছেন। এই আদালত থেকে অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সিদ্ধান্ত দিয়েছি।’
কামরুলের আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড আপিল বিভাগ অনেক উদার। ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিতে হয়।’ আদালত বলেন, ‘ক্ষমা চাইলে দুই লাইনে চাওয়া যায়। কিন্তু আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা যথাযথভাবে পুনরায় ব্যাখ্যা জমা দেব। এ জন্য আদালতের কাছে সময় চাইছি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা যদি মক্কেলের সুরক্ষা দিতে না পারেন, তাহলে আদালতে আসবেন না। যতবড় ক্ষমতাধরই হোন না কেন আইন সোজা পথে চলে, আঁকাবাকা চলে না। অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যেকোনো আদেশ দিতে সংকোচ বোধ করব না।’ এরপরই আদালত শুনানি ২৭ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করে ওই দিন দুই মন্ত্রীকে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন।