৮ মার্চ ২০১৬: বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের এক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে হাতিয়ে নেয়া বিপুল পরিমাণ অর্থের একাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে বাংলাদেশের এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, বেহাত হওয়া অর্থের মোট পরিমাণ প্রায় দশ কোটি মার্কিন ডলার। সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইনে রয়েছে। এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে অর্থ রক্ষিত ছিল, তারই একটি অংশ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে চুরি করা হয়েছিল। ঐ অর্থের একটি অংশ আদায় করা সম্ভব হয়েছে, এ কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাকি অর্থের গন্তব্য সনাক্ত করে তা আদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। কত পরিমাণ অর্থ ফেরত আনা হয়েছে, বিজ্ঞপ্তিতে তা উল্লেখ করা না হলেও কর্মকর্তারা বলছেন, বেহাত হওয়া অর্থের এক চতুর্থাংশের মতো আদায় হয়েছে। বিদেশে রাখা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার খবর এমন সময় এলো, যখন দেশেই একটি চক্র ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার একটি অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সাইবার অপরাধীরা। প্রাথমিক তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, চীনা হ্যাকারদের একটি দল বিপুল এ অর্থ প্রথমে ফিলিপাইনের ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে অন্য কোথাও পাচার করে। হ্যাকের মাধ্যমে অর্থ চুরির বিষয়টি জানার পর দ্রুত তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই অর্থ ফিলিপাইনে স্থানান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সেখানে পাঠানো হয় দুই কর্মকর্তাকে। তারা ১৬ থেকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দেশটির অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করে এসেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বিপুল এ অর্থ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের বিনিয়োগ যেভাবে সংরক্ষিত হয়, তাতে ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া হ্যাক করে অর্থ চুরি করা খুবই জটিল। বিষয়টি নিয়ে এখন বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দাপ্তরিক কাজে তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার ও অনলাইন কার্যক্রমের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার সতর্কতামূলক একটি অফিস আদেশও জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে ফিলিপাইনের দৈনিক দি ইনকোয়েরার পত্রিকায় গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ থেকে ১০ কোটি ডলার মানি লন্ডারিং হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করে। ওই খবরে বলা হয়, দেশটির মাকাতি শহরে অবস্থিত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের একটি শাখার মাধ্যমে ওই অর্থ ফিলিপাইনে আসে। চীনা হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সেখানকার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ অর্থ হাতিয়ে নেয়। হ্যাকার দল এ অর্থ প্রথমে ফিলিপাইনে পাচার করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থ পাচারের এ ঘটনা তদন্ত করছে ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল। বিভিন্ন তথ্যসূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পরে ওই অর্থ সেখান থেকে ক্যাসিনোসহ একাধিক হাত ঘুরে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য জানার পর গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৬ থেকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ডিজিএম জাকের হোসেন ও বিএফআইইউর যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রবকে পাঠানো হয় ফিলিপাইনে। সেখানে গিয়ে এ দুই কর্মকর্তা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংকো সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপিনাস’ (বিএসপি) ও অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে আলদা বৈঠক করেন। বিশেষ এ দুটি বৈঠকে হ্যাকার গ্রুপ চিহ্নিত করে টাকা ফেরতের ব্যবস্থার বিষয়ে তাদের সহায়তা চাওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, রিজার্ভের অর্থ কোন দেশে, কোথায় বিনিয়োগ বা সংরক্ষণ করা আছে তা সুইফট কোডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী সুরক্ষিত হিসেবে বিবেচিত এ নেটওয়ার্ক হ্যাক করে রিজার্ভ থেকে টাকা চুরির ঘটনা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ঘটেছে। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ অব বাংলাদেশের (এনপিএসবি) চ্যানেলের মাধ্যমে সুইফট ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নগদ আকারে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা হয়। বাকি অংশ বন্ড, স্বর্ণ ও অন্যান্য মুদ্রায় বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ হ্যাক করে চীনভিত্তিক একটি গ্রুপ। পরে তা শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে সরিয়ে নেয় তারা। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই শ্রীলঙ্কায় সরিয়ে নেয়া অর্থ ফেরত আনতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক।