১৫ জুন ২০১৫: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার। ভারতের দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় “এ শট ইন দ্য আর্ম ফর হাসিনা” শিরোনামে লেখা কলামে তিনি এ সমালোচনা করেন। ওই কলামে তিনি ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক সফরেরও সমালোচনা করেন। কুলদীপ নায়ারের কলামটি এখানে তুলে ধরা হলো : ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর হয়েছে অসময়ে। মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষতিগ্রস্থ ইমেজ পুণরুদ্ধারের জন্যই যেন ছিল এই সফর। কিন্তু মোদির সফরে শুধু ভারত-বিরোধী মনোভাবটাই বেড়েছে কারণ দিল্লী আর আগের মতো নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকেনি।
আমি জানি না, কেন এবং আর কত দিন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্বশীল শাসনকে আমাদের সমর্থন করে যেতে হবে। এটি ঠিক যে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা যিনি অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সংবিধান বা স্বীকৃত নীতিনৈতিকতাকে তিনি ইচ্ছেমতো বিদ্রুপ করবেন। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনের কথা বলা যায়। ভোটার ও সংশ্লিষ্টদের আতঙ্কের মধ্যে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। শেখ মুজিব নিশ্চয়ই তার কবরের মধ্যে নাড়া খেয়েছেন। রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক জান্তার শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মত প্রকাশের অধিকার পুণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সন্দেহ নেই, মোদির সফর মৌলবাদীদের মোকাবেলার সেক্যুলারপন্থীদের শক্তি যুগিয়েছে। কিন্তু তার নিজের মতোই চলেছেন। বিরোধী মতের লোকদের যেভাবে নির্দয়ভাবে দমন করেছেন তিনি, তাতে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার কি আদৌ মুক্ত রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার ওপর কোন বিশ্বাস ছিল?
এর জাজ্বল্যমান উদাহরণ হলো বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের প্রতি তার অপমানসূচক আচরণ। তিনি তার বাবা শেখ মুজিবের সহকর্মী ছিলেন এবং যিনি বাংলাদেশের একজন নীতিবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নির্বাচন বয়কটের বিষয়টি অচিন্ত্যনীয় ছিল। এটা সত্যি যে, নির্বাচন জেতার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন হাসিনা। তবু বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত এবং তাদের কিছু সংখ্যক প্রার্থী জিতে বেরিয়ে আসতো, তাহলে তারা মানুষের সামনে হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধীতা করতে পারতেন। সন্দেহ নেই, সাধারণ নির্বাচনেই শাসকদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই নির্বাচনে বোঝা যায় সরকার সাধারণ নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে কি না। ভারত সৌভাগ্যবান কারণ প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যেভাবে দেশটাকে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে নিয়েছিলেন, সেটা সযত্নে লালিত হচ্ছে। তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিলেন। শুধু গণমাধ্যমকেই চাপে রাখেননি, তিনি মৌলিক অধিকারকেও বাধাগ্রস্থ করেছিলেন। কিন্তু জনগণ সেই অবস্থাকে মেনে নেয়নি। তারা তাদের ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল সাধারণ নির্বাচনের সময়। এটা অকল্পনীয় ছিল যে শক্তিধর ইন্দিরা গান্ধীও পরাজিত হতে পারেন। ১৯৮০ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে প্রতিশোধের পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এটু দুঃখজনক যে জনতা সরকারের ধারেকাছে যারা ছিল, তাদের সবাইকে শাস্তি দিয়েছিলেন তিনি। ভারতের কংগ্রেস পার্টি অবশ্য শিক্ষা নিয়েছে। অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের অনুশোচনা করতে হয়েছে। আমার মনে হয় দলটা যদি জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো ভাল হতো। অনুশোচনা আর ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে পার্থক্য অনেক। দুঃখজনকভাবে, শাসনকার্যে জনতার কথা বলার অধিকারের আন্দোলন থেকেই যে দেশের জন্ম- সেই বাংলাদেশ তার অতীত অবস্থান হারিয়েছে। এই পরিণতিটা দুঃখজনক। এটা আরও গ্লানিকর হয়ে ওঠে যখন এই সব কিছুর মূলে এমন ব্যক্তি থাকেন, যার পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানের থাবা থেকে জনগণকে মুক্ত করেছিল। হাসিনা ছাড়া আর কাউকে এখানে দোষি করা যায় না। তিনি নিজেই গণতন্ত্রের আগুন নিভিয়ে দিচ্ছেন। শেখ মুজিবের কন্যার হাতেই এটা হচ্ছে- এটা শুধু হতাশার বিষয় নয়, বিব্রতকরও বটে। তিনি এমনকি জাতিকে আরও আষ্টেপিষ্টে শেকলে জড়াচ্ছেন। কিন্তু এটা ঘটতেই পারে যখন তিনি সঠিক আর বেঠিক, নৈতিক আর অনৈতিকতার মাঝের সীমারেখা মুছে ফেলেছেন। এ রকম পরিবেশে- হাসিনার ভূমিকা যখন একজন স্বৈরাচারীর মতো, তখন মোদির সফর এমনকি আরও দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশ সফরকালে কোথাও অন্তত তার বলা উচিত ছিলো যে বাংলাদেশ একটি বিপ্লবের ফসল আর এ ধরণের চিন্তার ধারাবাহিকতা এখানে থাকা উচিত। কিন্তু মোদি উল্টো হাসিনাকেই সান্ত্বনা দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ হতাশ হয়েছে কারণ তারা আশা করেছিল ভারত এমন কিছু করবে যাতে বোঝা যায় তারা হাসিনার শাসনে খুশি নয়। এটা সত্য যে, ছিটমহল বিনিময় নিয়ে দীর্ঘ দিনের প্রতিক্ষীত চুক্তি বাস্তবায়নে মোদি সক্ষম। কিন্তু এটাতে আসলে সব দলেরই সমর্থন আছে যখন বিষয়টা ভারতীয় পার্লামেন্টে আলোচিত হয়েছে। যদিও চুক্তি বাস্তবায়নের কৃতিত্বটা তারই হবে। কিন্তু এই সুযোগে তিনি সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ দিতে পারতেন এই চুক্তিতে সমর্থন দেয়ার জন্য। মোদি এককভাবে “বার্লিন প্রাচির” গুঁড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব নিলে সেটা অভদ্র দেখাবে। আমার মনে হয় পাকিস্তানের সমালোচনা থেকে বিরত থাকলেই তিনি ভাল করতেন। সমালোচনাটা যে শুধু অপ্রত্যাশিত ছিল তা নয়, একটা সময়- যখন দক্ষিণ এশিয়ার সংহতি নিয়ে তিনি কথা বলছেন, সে সময় ইসলামাবাদকে এককভাবে আলাদা করে দেয়াটা এড়াতে পারতেন তিনি। তার বোঝা উচিত ছিল, যেমনটা বুঝেছিলেন তার পূর্বসুরীরা, যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এক সময় যৌথ বাজার ব্যবস্থায় আসতে হবে এবং ব্যবসায়, বাণিজ্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি হবে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বিবৃতি ছিল এ ক্ষেত্রে অসহযোগীতামূলক। মোদি এমনকি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই তিনি বললেন, মোদির এজেন্ডার তালিকায় তিস্তা নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফর ছিল একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এটা থেকে ঢাকা একটা বার্তা পেতো যে তিস্তা সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে দিল্লীর মনোভাব ইতিবাচক। ঢাকাকে এটা বোঝানো যেতো যে মোদির সফরে হয়নি মানে এই নয় যে দিল্লী তার নিজের মতো চলছে। প্রকৃতপক্ষে, মমতার সফরে ঢাকাকে এতটুকু আশ্বস্ত করা যেতো যে যখনই বিষয়টির সুরাহা হোক না কেন, প্রক্রিয়াটা এখানে শুরু হলো।
সৌজন্যে : নয়া দিগন্ত অনলাইন