• সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ • গত সপ্তাহে ব্রিটেনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারার প্রথম নির্বাচিত বাঙালি নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমানকে নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব, জালিয়াতি আর ধর্মীয় ফেনোম্যানার অজুহাতে হাইকোর্টে নির্বাচন কমিশনের জাজ রিচার্ড মাওরী লুতফুর রহমানকে বরখাস্ত যেমন করেছেন, একই সাথে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচন থেকে বিরত, সেই সাথে কোর্ট কস্ট বাবত ২৫০,০০০ পাউন্ড জরিমানা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের এই রায় ঘোষণার পর পরই লেবার পার্টি, স্থানীয় লেবার দলীয় প্রার্থী জন বিগস, লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন, কনজারভেটিভ প্রার্থী, গ্রিন পার্টি রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। বরিস নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচন সহ আর যাতে এ ধরনের জালিয়াতি ও অবৈধ প্রভাব না ঘটে তা রোধে আশ্বস্থও করেছেন, আর জন বিগস এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশের অবসান যেমন হয়েছে, সেই সাথে সত্যের রাজনীতির জয় হয়েছে।
অপরদিকে লুতফুর রহমান শিবিরের লোকজন এবং ফার্স্ট পার্টি এই রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সেই সাথে জানা গেলো ফার্স্ট পার্টি আগামী ১১ জুনের নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন।
বাংলাদেশী কমিউনিটি-
লুতফুর রহমান রায়ে বাংলাদেশী কমিউনিটি চিরাচরিত ভাবে দুইভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কোন কনক্রিট আলোচনার বিপরীতে বাংলাদেশী রাজনীতির ডামাডোলে প্রবাসের মাটিতেও তারা দ্বিধাবিভক্ত এবং একই সাথে স্থানীয় মূলধারার রাজনীতির তল্পীবাহকে পরিণত হয়েছেন- দুই শিবিরের দুই গ্রুপের পক্ষ হয়ে বক্তব্য বিবৃতি থেকে অন্ততঃ সেটাই প্রতীয়মান হয়েছে, যতোটুকু আশা করা হয়েছিলো, ব্রিটেনের অন্যান্য যেমন আফ্রিকান, চায়নিজ, ইউরোপীয় কমিউনিটির মতো সেরকম কোন ঐক্যবদ্ধ কিংবা এককেন্দ্রিক তথ্য, যুক্তি এবং উত্তর কমিউনিটির ভালো-মন্দ চিন্তা ভাবনা না করেই বিভিক্ত বক্তব্য পরিস্থিতিকে বাংলাদেশী কমিউনিটিকে আরো বিভ্রান্তি ও দিক নির্দেশনাহীন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে প্রভাবশালী মিডিয়া ও মূলধারার নীতি নির্ধারনী স্থানে সমন্বিত এবং পজিটিভ বার্তা দিতে ব্যর্থতর নয়া সুযোগের দ্বার খুলে দিচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, ব্রিটেনের সর্বশেষ সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী টাওয়ার হ্যামলেটস বারা বাঙালি অধ্যুষিত বলা হলেও মাত্র ৩৩% বাঙালি জনগনের বাস এই বারাতে। এই ৩৩% জনগন ৬৭% বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করাটা যেমন দুষ্কর, তেমনি সেই কাজটি করতে দরকার সমন্বিত এককেন্দ্রিক ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরিকল্পিত এবং আদর্শ ক্যাম্পেইন ও নীতিমালা, যা একেবারেই অনুপস্থিত।
হাইকোর্টের ভার্ডিক্ট আর লুতফুর রহমান ওয়েব-
রিচার্ড মাওরীর হাইকোর্টের এই রায়ের ব্যাপারে লুতফুর রহমান নিজের ওয়েব সাইটে এক বিবৃতিতে আবারো নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবী করে লিখেছেন, তিনি এই সব কোন অন্যায় কাজ করেননি এবং একই সাথে ইলেকশন জাজ পক্ষপাতদূষ্ট, বিদ্বেষ প্রসূত এবং যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তা কোনভাবেই সঠিক নয়।
লুতফুর রহমান এর পক্ষে বিবৃতিতে তিনি হাইকোর্টের রায়ের আইনী চ্যালেঞ্জ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ও ঘোষণা করেছেন, সেই সাথে ফার্স্ট পার্টি থেকে ১১ জুনের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার কথারও উল্লেখ করেছেন।
এদিকে গার্ডিয়ানের সাথে সাক্ষাতকারে লুতফুর রহমানের সমর্থকেরা হাইকোর্টের রায়কে গণতন্ত্রের বিপরীতে ক্যু হিসেবেও উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
থার্টি এইট ডিগ্রি পিটিশন-
ইতোমধ্যে চার্লট গ্যারাডা, গ্যারি রেড্ডিন,জোসনা বেগম, সিয়ান রিলো র্যাকজার নেতৃত্বে থার্টি এইট ডিগ্রি পিটিশন নাম দিয়ে সমর্থকেরা ওয়েব এর মাধ্যমে সিগন্যাচার ক্যাম্পেইন শুরু করে দিয়েছেন, যেখানে ইতোমধ্যেই ৭,০০০ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে। এখানে তারা বলছেন, এই রায় কোন জাস্টিস নয়, এটা আগেই থেকে সাজানো জাস্টিস, এটা কোন গণতন্ত্র নয়, আমরা চাইনা আমাদের ব্যালট চুরি হয়ে যাক, কোন ধরনের ঘুষ ও বুলির(হুমকী, গুন্ডামি) কাছে। ধারনা করা হচ্ছে, যেভাবে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ৭,০০০ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে কোন প্রকারের প্রচার ছাড়াই, এই সংখ্যা অচিরেই মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।
টাওয়ার হ্যামলেটস স্ট্রাইক ব্যাক- গ্ল্যান রবিনস-
এবারের সংসদ নির্বাচনে লেফট ইউনিটি বা টিইউএসসি থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন গ্ল্যান রবিনস। ২৬ এপ্রিল ২০১৫ তিনি তার ব্লগে উপরোক্ত শিরোনামে লুতফুর রহমানের ভার্ডিক্ট নিয়ে নিজের মতামত বেশ গুছিয়ে এবং সুন্দর অথচ কিছু তথ্য সম্বলিতভাবে তুলে ধরেছেন। গ্ল্যান তার ব্লগে লিখেছেন, আমার এই বক্তব্য টিইউএসসির নয়, বরং আমার নিজের বক্তব্য। বলা বাহুল্য, গ্ল্যান রবিনসকে টাওয়ার হ্যামলেটসের অনেক বাসিন্দাই ব্যক্তিগতভাবে চিনেন। তিনি কমিউনিটির নানা কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বারার দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা তিনি। অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ব্রিটিশ রাজনীতির অন্ধর মহলের অনেক খবরা- খবর বেশ সুন্দর ও তথ্য সমৃদ্ধভাবে তিনি তার ব্লগে ও ইউটিউবে বিবৃত করে থাকেন।
গ্ল্যান রবিনস তার ব্লগে লিখেছেন, কেউ কেউ এই রায়কে বলছেন আইনী ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ইংলিশ আইন অব্যর্থ এবং আদালত সকল সমালোচনার উর্ধে। কিন্তু রবিনস বলছেন, আমার মনে হচ্ছে আমাদের অতীতে এ নিয়ে এক বা দুটি ভুল রয়ে গেছে।
তিনি লিখেছেন, আমি দেখেছি, আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ এই রাজনৈতিক প্রভাবান্বিত সিদ্ধান্ত থেকে- যা মোহমুক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক আশা ছিলো। আমাদের এই পলিটিক্যাল এস্টাবলিশম্যান্ট ভয়ভীতি দেখিয়ে ভিন্ন মত দমনের প্রচেস্টা কিন্তু এই বারার অনেকেই এখন আর মাথা নত না করতে উদ্যত এবং তারা স্ট্রাইক করতে প্রস্তুত।
রবিনস এই পর্যায়ে এসে পরিস্কারভাবে লিখেছেন, আমি জানি এখানে অনেক আইনগত বিষয়াদি রয়ে গেছে, যা চ্যালেঞ্জ করা হবে। তবে তার আগে এই ম্যাসেজটাই আমাদেরকে দিতে হবে- টাওয়ার হ্যামলেটস তা থেকে দূরে থাকুক।
গ্ল্যান রবিনস লিখেছেন, ইস্ট এন্ডের মধ্যে আমাদের রয়েছে রাজনৈতিক অভিজাত এক সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য। ১৯৩৬ সালে এই বারা থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেড ইউনিয়নস এবং লেবার মুভম্যান্ট আন্দোলনের জন্ম হয়েছিলো। তারপরেও টাওয়ারহ্যামলেটসবাসী ঘরের ভিতরে বসে থাকেনি, তারা মোসলীর মতো ফ্যাসিস্টকে কেবল স্ট্রীট থেকে বিতাড়িত করেছিলো। একই অবস্থা ৭০/৮০ সালে এনএফ, ৯০ সালে বিএনপি আর ২০১০ সালে ইডিএলকে তিনবার হঠিয়েছি। ১৯৪৫ সালে আমরা এখানে একজন জুয়িস্ট কম্যুনিস্ট এমপি নির্বাচিত করেছিলাম, যিনি আমাদের জন্য ডিসেন্ট হোম-এর ডিমান্ড করেছিলেন। তখন ঐ এস্টাবলিশম্যান্ট বলেছিলো আমরা ধর্মীয় জিগিরে আচ্ছন্ন। ২০০৫ সালে আমাদের এই বারাতে একজন অবৈধ রাজনীতিবিদকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলাম্ন, যিনি যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন- এটা কেবল এখানেই সংঘটিত ( সম্ভব) হয়েছিলো। গ্ল্যান রবিনস ঠিক এখানে এসে আক্ষেপ করে লিখেছেন, এটাই একমাত্র জায়গা, যেখানে একজন লেবার দল থেকে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে ব্লক করার জন্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলো, তখন তারা তাকে স্বাধীনভাবে (ইন্ডিপেন্ডেন্টভাবে) নির্বাচন করতে বাধ্য করেছিলো এবং তাদের পরাজিত করেছিলো দুই দুইবার।
গ্ল্যান রবিনস তার ব্লগের একেবারে শেষ প্যারায় এসে লিখেছেন, আগামী ৭ই মের সাধারণ নির্বাচনে এই এস্টাবলিশম্যান্টকে জানিয়ে দিন- ভোটের মাধ্যমে, আমরাই সিদ্ধান্ত নেবো আমাদের ভোট কাকে দেবো এবং আমাদের বারা কে রান করবে। এটাই হতে পারে আমাদের জুডিশিয়াল রিভিউ।
গ্ল্যান আরো লিখেছেন, চিন্তা করুন, আগামী ৮ই মে সকালে ডেইলি টেলিগ্রাফ খুলে রিচার্ড মাওরী আর এরিক পিকলস যখন দেখবেন বিরক্তিকর ইস্ট এন্ডাররা আর ভীড় করছেননা, যারা ভোট দিয়েছেন ট্রেড ইউনিয়নিস্ট এবং সোশ্যালিস্টদের- যারা বাংলাদেশী ভোটার নন, কিন্তু তারা দাঁড়িয়েছেন কাট, প্রাইভেটাইজেশন, রেসিজম এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
লুতফুর রহমানের কাছে এখনো রয়ে গেছে সেই সব আইনী ব্যবস্থাগুলো এখনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো- যা এই বারার আগামীর রাজনীতি আরো সরগরম হয়ে উঠবে সন্দেহ নাই।