স্বাধীনতাবিহীন সংবাদমাধ্যম হলো স্রেফ অপপ্রচারযন্ত্র। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের গণমাধ্যম রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে কমই স্বাধীন। অনলাইন ডয়েচে ভেলে-তে এসব কথা লিখেছেন বাংলাদেশী ফটোগ্রাফার ও দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম। তিনি লিখেছেন, যে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কষাঘাতে বিদ্ধ হয়ে নিজেকে খুঁজে পায়, সেটি চূড়ান্ত বিচারে মানুষের আস্থা অর্জন ও জনমত প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। মানুষ এখন কেবল একটি নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল নয়। মুখের কথা থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণকারী ব্লগ-রাঘব বোয়ালদের অপরাধ খুঁজে বের করতে সবসময় কিছু মানুষ থাকবেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হয়তো কিছু বিষয়কে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলে। এছাড়া কিছু মানুষ থাকেই, যারা গণমাধ্যমকে উটকো আপদ ভাবে। তবে গণমাধ্যমকে ঠেকানো তখনই উচিত, কেবল যখন এটি নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করে। অথবা যখন এর কর্মকাণ্ডের ফলে জনমানুষের ক্ষতি হতে পারে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ সমস্ত সীমা নির্ধারণ করে দেবে কে? তবে এ ধরনের বিতর্ক খুব বেশি দূর এগোয় না।
সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবসমই ক্ষমতাবান মহল থেকে প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে। এসব ক্ষমতাবান মহলের মধ্যে রয়েছে সরকার, কর্পোরেশন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠী। এটি সারা বিশ্বেই কমবেশি ঘটে থাকে। বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ একটি নির্বাচনের পর সরকারের বৈধতাই প্রশ্নের সম্মুখীন। সেখানে চিন্তার স্বাধীনতা দমন করাটাই ভিন্নমত দমন ও অন্যায্য দলীয় কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশী গণমাধ্যমে সবসময়ই কিছু নিষিদ্ধ বিষয় (ট্যাবু) ছিল, এখনও আছে। যেমন: সামরিক বাহিনীকে ছোঁয়া যায় না। টেলিযোগাযোগ কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধেও কিছু বলা যায় না, কেননা তারাই দেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা। এমনকি দাতা সমপ্রদায় ও গণমাধ্যম নিজেরা বেশ সতর্কতার সঙ্গে চলে। কিন্তু সামপ্রতিককালে সরকারি মিডিয়া চ্যানেলগুলো ঢাকায় সরকারের জন্য স্রেফ প্রচারযন্ত্র (প্রোপাগান্ডা আউটলেট) হয়ে উঠেছে। সরকারের সমালোচকদের টক-শোতে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। সরকারের একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে উপস্থাপকদের পক্ষপাতিত্বমূলক প্রশ্ন তোলাটাই সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক ইস্যু। তবে গণমাধ্যমের প্রতি সরাসরি হুমকি, ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী সমপাদক’দের গ্রেপ্তার, সাংবাদিক ও ব্লগারদের ওপর হামলা এর চেয়েও অনেক বড় উদ্বেগের কারণ। কর্তৃপক্ষ অস্বাভাবিক মাত্রায় ‘আদালত অবমাননা’র অভিযোগ তুলছে। এ বিষয়টিও ভয়ের সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। অসহনশীল সংস্কৃতির ফলাফলস্বরূপ, বহু মুক্তমনা সহিংসতার শেষ দেখেছেন। এর আগে কখনই আজকের মতো সমালোচনামূলক ভাবনার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। আর এখনকার মতো আর কখনই সমালোচক হওয়াটা এত বিপজ্জনকও ছিল না।
[লেখক: শহিদুল আলমের জন্ম ১৯৫৫ সালে। তিনি বাংলাদেশী ফটোগ্রাফার ও সমাজকর্মী। ‘ক্রসফায়ার’ শীর্ষক তার সামপ্রতিক একটি চিত্রপ্রদর্শনী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওই চিত্রপ্রদর্শনী সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।]