প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনাকে তার ক্ষমতা থেকে নিরাপদে এবং সহি সালামতে নামতে সাহায্যের অঙ্গিকার করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আপনার মতো প্রতিশোধপ্রবণ নই। আপনি নম্র, ভদ্র, সংযমী হোন। উগ্র স্বভাব ও জিঘাংসার মনোবৃত্তি বদলান। গণতন্ত্র ও সংলাপের পথে আসুন। আমরা আপনাকে সহি সালামতে নিরাপদে নামতে সাহায্য করবো এবং একই সমতলে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করবো। মানুষ যাকে খুশি বেছে নেবে। আসুন, সেই পথটা অন্তত খুলে দেই।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এসব কথা বলেন খালেদা জিয়া। দেশের চলমান পরিস্থিতি ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দল ও জোটের অবস্থান তুলে ধরতে এ সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে খালেদা জিয়া বলেন, আপনি বিনা ভোটে রাজকীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। এই দম্ভ ত্যাগ করুন। মনে রাখবেন, সব দিন সমান যায় না। এ পর্যন্ত যাই করেছেন, ৩টি সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতে দিন। এতে আপনার ক্ষমতা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় বসতে এবং বসার পর আপনি অনেক অপরাধ-অপকর্ম-অপকৌশল করেছেন। এখন রাষ্ট্রক্ষমতা আপনার কাছে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আপনি নামতে ভয় পাচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে খালেদা জিয়া গতকাল নেপালে ভূমিকম্পনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও নিহতদের স্মরণ করেন। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের প্রশংসা করেন। এছাড়া পহেলা বৈশাখে নারী নির্যাতন, নিখোঁজ দলীয় নেতা সালাহ উদ্দিন, ছাত্রদল নেতা অানিসুর রহমান খোকনের সন্ধান বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, সালাহউদ্দিনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিষ্ঠুর বিদ্রুপ করেছেন। আমরা উৎকণ্ঠিত। আমরা তাদের সন্ধান চাই। তাদেরকে অবিলম্বে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। প্রকৃতপক্ষে দেশে এখন কোনও মানুষের সামান্যতম নিরাপত্তাও নেই। যে-ভাবেই ক্ষমতা কব্জা করে থাকুক না কেন, দেশে তো একটা সরকার আছে।
নিজের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি অাছে কী নেই এমন বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, অবরোধ তো অামি একক সিদ্ধান্তে ডাকিনি। এটা জোটের সিদ্ধান্তে হয়েছে। অবরোধ ওঠানো হলেও জোটের সঙ্গে অালোচনা করা হবে। তবে তিনি এও জানান, সিটি নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবরোধ নেই এবং সারাদেশে এর সক্রিয়তা এখন নেই।
সারাদেশে বোমা হামলায়, পেট্রোলবোমার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের কর্মসূচি ভঙ্গ করতে পুলিশ-র্যাব-বিজিপির পাহারায় রাজপথে ও মহাসড়কে জোর করে যানবাহন নামিয়েছে। সে-সব যানবাহনে রহস্যজনক বোমা হামলায় অনেক নিরাপরাধ মানুষ নিহত ও দগ্ধ হয়েছেন। সশস্ত্র প্রহরায় চলাচলরত যানবাহনে কীভাবে এমন হামলা হয়েছে এবং ঘটনাস্থল থেকে কেন অপরাধীরা ধরা পড়েনি তা আজও রহস্যে ঢাকা। তবে প্রতিটি ঘটনায় মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তাদের বাড়ি-ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, অনেককে বিনা বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নৃশংস নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করা হয়েছে অনেক তরুণকে। বিরোধী দলের কর্মীদের ধরে পুলিশে দিয়ে মিথ্যা মামলা সাজানোর সুযোগ করে দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আর্থিক পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে। অথচ অস্ত্র, গুলি, বোমাসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেকে ঘটনাস্থল থেকে ধরা পড়ার পর উপরের নির্দেশে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, মানুষ মারায় যদি জেতার প্রশ্ন আসে শেখ হাসিনা তাতে অবশ্যই জিতেছেন। তবে কেঁদে তিনি জিততে পারেননি। শেখ হাসিনার পরিকল্পিত নৃশংসতার শিকার হয়ে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য তার কান্নাকে এদেশের বেশির ভাগ মানুষ ‘কান্নার অভিনয়’ হিসেবেই মনে করেন। তাই তিনি যত কাঁদেন এবং যত অপপ্রচার করেন, মানুষ ততো বেশি মুখ ফিরিয়ে নেয় তার দিক থেকে।
কেঁদে উঠলেন খালেদা জিয়া:
সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে কেঁদে ওঠেন খালেদা জিয়া। মুছেন নিজের জলসিক্ত চোখ। নিজের স্বামী ও প্রয়াত সন্তানের কথা তুলে প্রায় দুই পর্যায়ে ২০ সেকেন্ড সময় নীরব থাকেন।
এ সময় তিনি বলেন, আমি আমার প্রিয় দেশবাসী, বিশেষ করে ঢাকাবাসীকে বলবো, আপনারা দেখছেন, ক্ষমতার দম্ভে আমার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে! আমার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশকে ভালোবেসে এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে আমি আমার আদরের ছোট ছেলেটিকে চিরকালের জন্য হারিয়েছি। আমার একমাত্র জীবিত সন্তানটি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দূরদেশে চিকিৎসাধীন। জীবনের এই প্রান্তে এসে প্রিয় মাতৃভূমিতে স্বজনহীন পরিবেশে চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখনও আমি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমতো সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এখন আপনারাই আমার স্বজন, আপনারাই আমার আত্মীয়।
হত্যার অভিযোগ করলেন সরকারের বিরুদ্ধে:
খালেদা জিয়া বলেন, এতোদিন তারা প্রচার করতো যে, আমি নাকি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের কোনও জনসমর্থন নেই। কিন্তু আমি জনসংযোগে নামতেই যে-দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে, তাতে তাদের এতো দিনকার সব প্রচারণা মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন। তাদের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন।
তিনি দাবি করেন, প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষের সামনে এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উত্তরা, কাওরানবাজার, ফকিরেরপুলের কাছে ও বাংলামোটরে আমার গাড়িবহরে পরপর চারদিন হামলা করেছে। সবচেয়ে মারাত্মক হামলার ঘটনা ঘটেছে কাওরানবাজারে। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে হামলা চালায়। বহরের অনেকগুলো গাড়ি ভেঙ্গে ফেলেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানসহ কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী, কর্তব্যরত সাংবাদিক ও নেতাকর্মী আহত হন। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।
তিনি দাবি করেন, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আমি তখন সবেমাত্র গাড়িতে উঠে বসেছি। আমি যে-পাশে বসা ছিলাম, সেই পাশেই গাড়ির জানালার কাঁচে গুলি লাগে। এতে গ্লাস ভেদ না করলেও তা ফেটে যায়। আল্লাহর রহমতে অল্পের জন্য আমার জীবন রক্ষা পায়। কতটা মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করলে বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাঁচ ফেটে যায়, তা সবাই বোঝে। এটা যে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সুপরিকল্পিত হামলা ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তার মতে, প্রতিটি হামলার ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিদের সরাসরি উস্কানির ফল এবং সুপরিকল্পিত। এসব হামলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অংশ নেয়। সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদনে হামলাকারীদের অনেকের চেহারা স্পষ্ট। অনেকের নামধাম ও সাংগঠনিক পরিচয় আপনাদের রিপোর্টেই তুলে ধরা হয়েছে। টিভি ফুটেজেও হামলাকারীদের স্পষ্ট চেনা গেছে। সন্ত্রাসীরা কেউ কেউ সাংবাদিকদের কাছে হামলায় অংশ নেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছে।
সিটি নির্বাচন টেস্ট কেস:
খালেদা জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে তার দল টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছে। তার দাবি, এই টেস্ট কেসে সরকার, ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শোচনীয়ভাবে ফেইল করে চলেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে।
সেনা নিয়োগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থানকে খালেদা জিয়া ধূর্ত বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমরা বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্রবাহিনীকে নির্বাচনি এলাকাজুড়ে ভোটের দিন এবং আগে-পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোতায়েন করতে আবারো দাবি জানাচ্ছি।
টাকা নিবেন, ভোট দেবেন বিবেকমতে:
খালেদা জিয়া বলেন, দেশের সম্পদ লুটপাট করে এবং আপনাদের রক্ত শুষে এরা টাকার পাহাড় গড়েছে। কাজেই এরা যে টাকা বিলাচ্ছে, সেটা আপনাদেরই টাকা। ওদের কাছ থেকে এ টাকা নিলেও ভোট বিক্রি করবেন না। টাকা নেবেন কিন্তু বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবেন। কারণ, ভোট বিক্রি আর ঈমান বিক্রি একই কথা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরেরা যেভাবে উগ্র-সন্ত্রাসী ও দাম্ভিক হয়ে উঠেছে কোনওভাবে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল কেড়ে নিতে পারলে তারা আপনাদেরকে আর মানুষ বলেই গণ্য করবে না।
তিনি অারও বলেন, জোর করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে গেলে মা-বোনেরা নিরাপদে থাকতে পারবেন না। ব্যবসায়ীরা ঠিক মতো ব্যবসা করতে পারবেন না। প্রবীণ ও সম্মানিত নাগরিকদের সম্মান থাকবে না। তরুণদের ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা আরও বিপথগামী হবে। শিক্ষাঙ্গন আরও কলুষিত ও সন্ত্রাস কবলিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ কয়েকজন নেতা, বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য, নাগরিক সমাজের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় বিশিষ্টজনেরা।