অনেকে প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন।কিন্তু ঠিকই কথা রেখেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রতি মাসে প্রতিশ্রুত অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন। বাদ পড়েনি কোনো মাসেই।
কখনো স্বৈরশাসক, কখনো সেনাশাসক, আবার কখনো প্রেমিক হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছেন তিনি। কিন্তু এ যেন ভিন্ন এক এরশাদ। যে পরিচয়টা রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে। আর তা অন্তরালেই রাখতে থাকতে চান সারাজীবন। কিন্তু ‘গোপন কথাটি’ থাকেনি গোপন। অন্তরঙ্গ আলাপের সূত্র ধরে তার(এরশাদের) ব্যক্তিগত সহকারি এ নিয়ে মুখ খুললেন বাংলানিউজের কাছে। তাতেই পাওয়া গেল ভিন্ন এক এরশাদকে; যে এরশাদ দরদী, সহৃদয়, দরিদ্রবান্ধব, মানুষের দু:খে কাতর আর সমব্যথী।
টানা দুই যুগ ধরে নানাভাবে চিত্রায়িত হয়ে আসা এরশাদ রানা প্লাজা ট্রাজেডির সময় গিয়েছিলেন হতাহতদের দেখতে। এনাম মেডিকেলে আহতদের বিছানার পাশে চোখের জল ফেলেছিলেন নি:শব্দে। শাহীনুর বেগম, আরতী রানী দাস, রিক্তা বেগম, সোনিয়া খাতুন, পাখি বেগম, আন্না খাতুন ও লাবনী বেগমের বিছানার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এই হতভাগা নারীদের কারো এক পা আবার কারো দু’পা-ই কেটে উদ্ধার করা হয়েছিলো। এই ভাগ্যবঞ্চিতদের স্বজনদের হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন নগদ টাকা। আর ঘোষণা দিয়ে এসেছিলেন তাদের দায়িত্ব নেবেন। অনেকে মনে করেছিলেন রাজনীতিকরা তো কতো প্রতিশ্রুতিই দেন! কিন্তু বাস্তবে তা রাখেন না।
কিন্তু এরশাদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি তার কথা রেখেছেন। এনাম মেডিকেলের কর্ণধারকে বলেছিলেন এই ৮ জনের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে, যাতে তাদেরকে সহায়তা করতে পারেন। এনামুর রহমান ব্যাংক (ইউসিবিএল সাভার শাখা) অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন।
আর সেসব অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসের ৮ তারিখের মধ্যে প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে দিয়ে যাচ্ছেন। এখানেই শেষ নয়। যাদের জন্য টাকা দেওয়া হচ্ছে তারা ঠিকমত তা তুলে নিতে পারছেন কিনা সে খোঁজও নচেঁ্ছন ব্যাংকে ফোন দিয়ে।
শুধু শাহীনুর বেগমের হিসেবে ৮ মাসের টাকা জমা রয়েছে। অন্যরা টাকা তুলে নিয়েছেন। পরে ব্যক্তিগত সহকারি জাহাঙ্গীর আলমকে বলেছিলেন, শাহীনুর বেগমের খোঁজ নিতে। শাহীনুর বেগম ভালো আছেন জেনে আনন্দিত হয়েছেন।
শুধু এখানেই নয়। তাজরীন ফ্যাশন ট্রাজেডির পরও দু’টি শিশুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাদেরকে মিঠাপুকুরে (গ্রামে) বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। শিশু দু’টির নানা শাজাহান মণ্ডলের মাধ্যমে নিয়মিত টাকা দিয়ে যাচ্ছেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।
এরশাদের ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ১৫ বছর ধর এমন একজন সহকারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘স্যারের (এরশাদ) ভেতরের মানুষটা অনেকে আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি তারা জানি উনি কত বড় মহৎ।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে যা বেতন পেতেন তা কোনো দিনই নিজের জন্য ব্যবহার করেননি। এমনকি এরপর এমপি হিসেবে যা বেতন-ভাতা পেয়েছেন তা-ও কোনোদিনই নিজের জন্য রাখেন নি। এমনকি চেকের মাধ্যমে কোনো টাকাও উত্তোলন করেন নি।’
ওই ব্যক্তিগত স্টাফ আরও জানান, সোনালী ব্যাংক সংসদ ভবন শাখার হিসেবে জমা হয় তার বেতন-ভাতা। মাস শেষে ডিও লেটার পাঠিয়ে দেন এরশাদ। সেই ডিও লেটারের তালিকা মোতাবেক প্রতিশ্রুতদের ব্যাংক হিসেবে দিব্যি পৌঁছে যায় টাকা।
বর্তমানে বেতন-ভাতা মিলিয়ে মাসে ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা পান। এই টাকা দিয়ে তার সব প্রতিশ্রুতি পূরণ হয় না। তাই প্রতিমাসেই আরও কয়েক লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। অবশ্য কতো টাকা ভর্তুকি দিতে হয় এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি এই ব্যক্তিগত সহকারি। তবে ৩১টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক-হিসেবে বিভিন্ন অংকের টাকা যায় বলে জানিয়েছেন। এরই মধ্যে অনেক এতিমখানা ও দুস্থ শিশুদের লালনকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বাসা থেকে ভিক্ষুক যেন খালি হাতে না ফেরে সে বিষয়ে রয়েছে এরশাদের কঠোর নির্দেশনা। এমনকি তার গাড়ির কাছে থেকে ভিক্ষুক খালি হাতে ফিরে গেলেও ব্যক্তিগত সহকারিদের কৈফিয়ত দিতে হয়। এজন্য গাড়িতে নগদ ৫০ ও ১০০ টাকার নোট রাখা হয়।
বাসা ও চলতিপথে ভিক্ষুককে দিতে চলে যায় মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা। এ নিয়ে কখনই কৃপণতা না করার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
এখানেই শেষ নয়। ব্যক্তিগত স্টাফ, বাসার কর্মচারী, গাড়ি চালকদের নিয়েও তার ভাবনার কমতি নেই। নতুন বাজার এলাকায় একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। এর সব ফ্লাট ব্যক্তিগত স্টাফদের মাঝে বিতরণ করে দিয়েছেন।