বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেওয়া হলেও ১শ’ দিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্ধের ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ হয়ে গেছে ২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ১শ’ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার (১৬ এপ্রিল) দেশের সবগুলো জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। চট্টগ্রাম, মংলা, বেনাপোল, হিলি, বুড়িমারি, আখাউড়া, তামাবিলসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দরে পণ্য ওঠা-নামা ও পরিবহন ব্যবস্থায় অবরোধের বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই।
সূত্র জানায়, অবরোধের শুরুতে নজীরবিহীন নাশকতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছিলো, নাশকতা কমে আসায় সে আতঙ্কও এখন নেই। সাময়িক সময়ের জন্য রাতের বেলায় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও এখন চলছে পুরোদমে।
অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, সড়ক-নৌ ও রেল যোগাযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের অস্তিত্ব নিয়ে বিএনপির নেতারাও রয়েছেন অন্ধকারে। কেউ বলতে পারছেন না সরকার পতনের লক্ষ্যে গত ৬ জানুয়ারি থেকে চালিয়ে আসা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির সর্বশেষ অবস্থা কী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, অবরোধ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সুতরাং এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। তাছাড়া আমি অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছি।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এ ব্যাপারে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। আমি কিছুই বলতে পারবো না। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ ৯২ দিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের পর ৫ এপ্রিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘খালি হাতে’ ঘরে ফিরলে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ বা প্রত্যাহারের ঘোষণা ছাড়াই দলীয় প্রধানের ঘরে ফেরার সিদ্ধান্তে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন।
সম্প্রতি গুলশানের বাসায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, দেশে আর কোনো অবরোধ নেই। বিএনপি এখন ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছে।
পরে অবশ্য নিজের দেওয়া বক্তব্য অস্বীকার করেন বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ প্রত্যাহার বা স্থগিত করার ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকায় সাংবাদিকদের কাছে ‘অবরোধ নেই’ বললেও পরে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার।
এদিকে হরতাল থেকে সরে এসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দেশি-বিদেশি মহল সাধুবাদ জানালেও অবরোধ প্রত্যাহার না করায় খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তাদের মধ্যেও রয়েছে নানা জিজ্ঞাসা।
সূত্র জানায়, হরতাল প্রত্যাহার করে সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, স্পেনের রাষ্ট্রদূত লুইস তেয়াদা সাঁকো এবং সুইডেনের রাষ্ট্রদূত জোহান ফেয়ারসেল সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে ধন্যবাদ জানান।
জানা গেছে, বিদেশি এসব কূটনীতিক অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যহারের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার মতামত জানতে চান।
সূত্রমতে, টানা ১শ’ দিন ধরে অবরোধ কর্মসূচি রেকর্ড গড়া খালেদা জিয়া আপাতত অবরোধ প্রত্যাহার বা স্থগিত করার ঘোষণা দিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে দেশি-বিদেশি মহল যাই বলুক, ‘অকার্যকর’ অবরোধ কর্মসূচি জিইয়ে রাখতে চান তিনি। তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল বিপক্ষে গেলেই অবরোধ চাঙ্গা করতে দলের নেতাকর্মীদেরকে পুনরায় নির্দেশ দেবেন বিএনপি প্রধান।
সরকার পতনের লক্ষ্যে ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মী ও জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকায় শুরুতেই ভেঙে পড়ে তার অবরোধ কর্মসূচি। পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস ও ককটেলবাজির মাধ্যমে প্রথম দিকে জনমনে কিছুটা আতঙ্ক ছড়াতে পারলেও এক সময় জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এলে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক ছিলো খালেদা জিয়ার হঠকারি সিদ্ধান্ত। এরপর আর কোনো ইস্যুতেই হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সুবিধা করতে পারবেন না তিনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম দু’টি হরতাল-অবরোধকেও হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করেছেন বিএনপি প্রধান।