প্রায় পাঁচ- ছয় বছর আগে আমার বাচ্চাদের স্কুল সুবাদে একটি পরিবার এর সাথে আমার পরিচয় হয় ! স্বামী-স্ত্রী আর তাদের দুটো সন্তান ! একটি ছেলে, একটি মেয়ে। মেয়েটি বড় আর ছেলেটি ছোট ! মেয়েটি স্কুল এ যায় আর ছোট ছেলেটি কয়েক মাস বয়স ! যেহেতু বাবাকে চাকুরী করতে হয়, সেহেতু এক সাথে দুটো বাচ্চা লালন, পালন, দেখা-শুনা করা এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একজন মায়ের একার পক্ষে বর্ণনাতীত কষ্টকর। যা কিনা আমি হারে হারে টের পাই ! তার মাঝে ছেলে শিশুটি কিছুটা শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। একটি পা বাঁকা। জন্মের পর থেকেই ছোট্ট শিশুটির পায়ে পর্যায়ক্রমে কয়েক দফা সার্জারি হয়। চিকিৎসার অংশ হিসেবে শিশুটির পায়ে লোহার রড লাগানো এক ধরনের বিশেষ জুতা পরিয়ে রাখতে হয় দৈনিক কয়েক ঘণ্টা। সেই জুতা যখন পরানো হয়, শিশুটি শরীরের সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করতে থাকে। সেই গগনবিদারী চিৎকার কোন মানুষের পক্ষে বেশীক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। অনবরত সেই কান্না একটা সময় স্তব্দ হয় ঠিকই কিন্তু মায়ের কান্না স্তব্দ হয় না ! এভাবে দিনের পর দিন..বছর দু-এক চিকিৎসা চলে।সৃষ্টিকর্তার মহিমায় এইভাবে একসময় শিশুটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে, স্কুলে যায় ! আমি সেই মায়ের চোখের পানির সাথে এই নিতান্ত কষ্টের দিনগুলোর গল্প শুনে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি !
সত্যি কথা বলতে কি এই রকম আরও বেশি কষ্টের গল্প শুনে ছিলাম আমার শাশুড়ি, শশুর আর ননাস এর মুখে আমার স্বামীর ছোট বেলার এক দুর্ঘটনার কথা, আর সেই চরম দুর্দিনের কথা ! অনিশ্চয়তায় ভরা কিছু দিনের কথা ! সেদিন ও শুনে বিস্মিত হয়ে ছিলাম, একজন বাবা-মায়ের সন্তানকে ঘিরে কত গভীর আত্মবিশ্বাস আর মমতা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম ! সেদিন ও এইসব কিছু শুনে চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি ! আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অপার মহিমা আর দানে ফিরে পাওয়া সন্তান পিতামাতার চোখে মুখে যে আনন্দ, বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ! সেই গল্প শুনে আমার ও কৃতজ্ঞতায় আর শ্রদ্ধায় মাথা শুধু নত হয়ে আসছিল ! আমার এই কৃতজ্ঞতা আজীবন বয়ে বেড়াতে চাই ! প্রচন্ড সাহসী আর বুদ্ধিমতি আমার শাশুড়ি জীবনের মাঝ পথে স্বামীকে হারিয়েও শুধুমাত্র পুত্রদের সাথে নিয়ে সাতটি ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন !
আল্লাহর ইচ্ছায় আমার আম্মা হয়ত এমন চরম কষ্ট করেন নাই কিন্তু মা হিসেবে ছোট বড় অগনিত কষ্ট করেছেন ! সেই গল্প গুলো শুনেছি, দেখেছি আর অনুভব করেছি কারণ ভাই- বোনের মধ্যে আমার অবস্থান চতুর্থ বলে ! নিজের মায়ের ত্যাগ আর অকৃপণ ভালবাসা বলে শেষ করতে পারব না ! আমার মত হয়ত সবাই ! কেওই বলে শেষ করতে পারবে না ! তারপর ও শুধু একটি কথাই বলব, প্রচন্ড মেধাবী, ধৈর্যশীলা ক্লাস এ বরাবরই প্রথম/ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী আমার মা স্বামী, পাঁচ সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ করতে অন্তত ধর্মীয় সুশাসনের মাঝে মানবিক গুনাবলী নিয়ে আমাদের তৈরী করা, অফুরন্ত মাতৃত্ব সম্পন্ন আমার মায়ের ভালবাসার ছায়ায় শুধু আমরা পাঁচ ভাই- বোনই যে ছিলাম তা নয়, আমার তিনটি ছেলে-মেয়েরা সহ আত্মীয় স্বজনের অনেকেই ! পরিবারের জন্য নিজের সকল ইচ্ছা, প্রতিভা ত্যাগ আর ভালবাসার ফসল আজকের আমরা ! আমাদের কথা আর নাইবা বললাম !
গেল বছর আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে বড় বোনটিকে দেখে আসলাম, অসম্ভব ধৈর্যশীলা আমার বোনটি একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন পুত্রবধু হিসেবে বছরের পর বছর সকল ত্যাগ স্বীকার করে কিভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে ! দুই বছর আগে বাংলাদেশে গিয়ে দেখলাম আমার ঘনিষ্ঠ দুই জন বান্ধবী রুনা এবং কলি কে..বাবা-মা দুই জনের দায়িত্ব পালন করছে একাধারে এই দুজন মমতাময়ী মা ! সাহসী দুই নারী !
হয়ত এমন নাহয় আরো ছোট কিংবা বড় কষ্ট আমার খালারা-ফুপ্পিরা-চাচিরা-মামীরা-আমার ননাস-ননদেরা-জা’রা-ভাবিরা এবং এখানেও আমার চার পাশে সবাই করেছেন এবং করছেন ! এর ফলাফল ও প্রতিটা পরিবারে দেখতে পাই ! সন্তানের জন্য সব মা’ই কষ্ট করেন হয়ত কম আর বেশি ! আর এমন করে আরও কোটি কোটি অসাধারণ মায়ের গল্প বলতে পারব ! এই সকল অসাধারণ মায়ের হাসিমাখা মুখের দিকে চেয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে ! একজন নারী কখনো কাঁদে, কখনো হাসে। এ হাসি কিংবা কান্না’র পারদ উঠা-নামা করে আবেগ ভালোবাসার ব্যারোমিটারে। সন্তানের প্রতি, পরিবারের প্রতি প্রতিটি নারীর ত্যাগ, ভালোবাসা অসীম ! প্রাণভরা দুয়া আর শ্রদ্ধা পৃথিবীর সকল মাকে ! সৃষ্টিকর্তা যেন সকল মাকে তার সন্তানদের পরম মমতায় জড়িয়ে রাখেন- আমীন !
একজন অতি সাধারণ মা হিসেবে “মা দিবস” উপলক্ষে আমি শুধু আমার মনের অনুভূতি গুলো বললাম, যা হয়ত প্রায় সময়ই আমার মাকে, শাশুড়িকে আর কাছের জনদের বলে থাকি ! তারপর ও যেন সব বলা হয়না, বলতে পারি না ! মাকে নিয়ে ছোট করে বলা যায় না, আর এখানে আমি কয়েকটা অসাধারণ মায়ের কথা বলেছি ! যেখানে পৃথিবীর অধিকাংশ মা’ই আমার চোখে অসাধারণ !
–ফারহানা কামাল বারী , London