শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো গত শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি হাসপাতালে নেয়ার পথে ইন্তিকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাহী রাজিউন)। তাঁর এ আকষ্মিক ও অকাল মৃত্যুতে জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতিটি নেতা কর্মীর পাশাপাশি বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী শোকে মূহ্যমান। পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যুতে স্বাভাবিক ভাবেই ‘মা’ হিসাবে বেগম খালেদা জিয়া গভীরভাবে শোকাহত এবং মানসিক ভাবে বিপর্যন্ত। কারণ বিএনপির লক্ষ্ কোটি সন্তান সমতুল্য নেতা কর্মীর ‘মা’ হিসেবেও শিশু মুক্তিযুদ্ধা আরাফাত রহমান কোকোর প্রতি তাঁর একটু বাড়তি দ্বায়িত্ব ছিল।
১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যার কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আশা করেছিল সেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে তাদের কথা মত আত্মসমর্পণ করে নিজের পরিবারের জন্য বেতন ভাতা নেয়ার সুবন্দোবস্ত করে গিয়েছিলেন। আর ছোট শিশু কোকোর পিতা তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান নেতৃত্বহীন জাতিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লে, পাকিস্তানি স্বৈরশাসকগোষ্টির কাছে নিজের পরিবারের সকল সদস্যকে ‘প্রধান’ টার্গেটে পরিনত করেন। বড় নেতার পরিবার পেলো পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রাজকীয় ভাতা ও আরাম আয়েশের নিরাপত্তা। বাংলাদেশের মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা যখন শহীদ জিয়ার আহবানে যুদ্ধের ময়দানে দখলদার বাহিনীর প্রতিনিয়ত গণহত্যা মোকাবেলা করে জীবন মরণ লড়াইয়ে লিপ্ত ঠিক তখন বর্তমান জবরদখলকারী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মের পরে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যরা মিষ্টি বিতরণ করলো। আর মেজর জিয়াউর রহমান যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করার অপরাধে তাঁর দুধের শিশু আরাফাত রহমান কোকোর সাথে তাঁর মা খালেদা জিয়া ও বড় ভাই তারেক রহমানের জায়গা হলো পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। বিষয়টি কত হৃদয় বিদারক ছিল আজকের কিছু খবরের সাথে তুলনা করলে সহজেই বুঝা যাবে।
বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ঝালকাঠি, চাপাই নবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনরত বিরোধীদলের নেতাদেরকে পুলিশ ধরতে না পেরে তাদের স্ত্রী সন্তানদের থানায় নিয়ে নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু ভোটের অধিকারের জন্য স্বগোত্রীয়দের নির্মম নির্যাতনের খবর দেখে গাঁ শিউরে উঠে, স্বৈরশাসকদের সেন্সর আর ‘ভদ্র থ্রেটের’ পরে যদিও খুব সামান্যই প্রকাশিত হচ্ছে। তখন অখন্ড পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার আহবানের পর তাঁর পরিবারকে গ্রেফতার করে নির্যাতনের ভয়াল দিনগুলির চিত্রের কিয়দংশই অনুমান করা সম্ভব।
ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বীরমুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনীর প্রধান এবং রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সেই পুত্র কোকো, তাঁর মা যিনি আবার দেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় দলের প্রধান, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী (কাগজে কলমে নয়! গত সবকটি জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র নেতা যিনি সর্বোচ্চ আসনের সবকটি আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে প্রতিবারই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত) গত প্রায় আট বছর ধরে অসুস্থ সন্তানটির মুখ দেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। একজন ‘মা’র কাছে এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?
বিগত অন্তর্বতীকালীন জরুরী সরকারের সময়ে সম্প্রসারণবাদ ও তাদের এদেশীয় দালালদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করা ও বিএনপিকে সুপরিকল্পিতভাবে ‘বিলীন’ করার চক্রান্তে সফল হতে না পেরে বেগম জিয়াকে জোরপূর্বক বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্ঠা করা হয়। তখন একটি বিষয় ওপেন সিক্রেট ছিল যে, বেগম খালেদা জিয়াকে চাপে রাখার জন্য এবং ‘জাতীয়তাবাদী শক্তিকে’ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নিমিত্তে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করে তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়। দেশ রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের আপোষহীন নেত্রী তাঁর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী সেদিনও দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির সাথে আপোষ করেননি।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক জাতীয়তাবাদের আজকের অগ্রপথিক বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ও সাবেক নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মরহুম মাহবুব আলী খানের কন্যা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিদ ডা. জোবায়দা রহমানের বক্তব্য থেকে বিষয়টির শতভাগ সত্যতা প্রমাণিত। গত ২৪ জানুয়ারি প্রিয় আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর ডা. জোবায়দা রহমান তাঁর ফেসবুক পেইজে এক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন, ‘মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে দেশ বড়।’ স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মায়ের (খালেদা জিয়া) কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- সন্তান (তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান) নাকি দেশ? এর উত্তরে মা বলেছিলেন- দেশ। এরপর অমানুষিক নির্যাতন নেমে এলো তাঁর দুই সন্তানের উপর। এক সন্তানের পায়ের হাড়গুলো ভেঙে দেয়া হলো, আরেক সন্তানকে ইলেকট্রিক শক’এর সাহয্যে ব্রেন ড্যামেজ করে দেয়া হলো।
এরপর আবার সেই ‘মা’কে জিজ্ঞেস করা হলো- আপনার কাছে সন্তান বড় নাকি দেশ? উনি কেঁদেছেন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই বলেছেন- দেশ। এই দেশ আমার ‘মা’ এই দেশ আমার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন। আমি আমার মায়ের কাছেই থাকবো আমার স্বামীর স্বপ্নের দেশেই থাকবো।
আমার দুই সন্তানকে আমি আল্লাহর কাছে সপে দিয়েছি। আমি বেঁচে থাকবো আমার ১৬ কোটি সন্তানদের মাঝে।’ (সূত্র: দৈনিক আমাদেরসময় ডট কম, ২৮ জানুয়ারী ২০১৫)
দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজনীতিতে জড়িত না থেকেও শুধু বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক জাতীয়তাবাদ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ জিয়া পরিবারের একজন সদস্য হবার কারণেই ৭১’এর শিশু মুক্তিযুদ্ধা আরাফাত রহমানকে নানমুখী জুলুম-নির্যাতন, হেনস্তা-অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে। অসুস্থ হয়ে প্রবাসে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেও তিনি চরম প্রতিহিংসামূলক বৈরিতা থেকে নিষ্কৃতি পাননি। শুধু কি তাই, যার বাবা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি আধুনিক সেনাবাহিনী গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁর আদরের সন্তান কোকোর লাশ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত গোরস্তানে সকল নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে সমাহিত করতে দেয়া হয়নি। এতে করে বর্তমান ফ্যাসিবাদের শাসনকালে বিশ্ব ইতিহাসে প্রতিহিংসার এক নতুন নজির স্থাপন করা হলো। আজ সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা জেল থেকে ছাড়া পায়, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার নামে দায়েরকৃত চার্জশিট হওয়া মামলাও আদালতকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী ক্ষমতাবলে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু অন্তর্বতীকালীন সরকারের সকল কাজের বৈধতা দানের শর্তে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৭১’র শিশু মুক্তিযুদ্ধা আরাফাত রহমানের প্যারোলের মুক্তির সময়সীমা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। আইলো যুগ ডিজিটাল ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের সেই উক্তি ফের উচ্চারণ করে বলব, ‘সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!’
তবে যে শাসকেরা শহীদ জিয়ার রক্তে গড়া দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিক সেনাবাহিনীর ৫৭ জন মেধাবী ও চৌকস অফিসারদের একদিনে হত্যা করতে পারে তাদের জন্য সব কিছুই করা সম্ভব। জাতির বীরত্বের প্রতিক সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানরা নিশ্চয় সবকিছু অবলীলায় ভুলে যাবে না। ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনকে তারা নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে।’ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে ‘আপোষহীন’ আর ‘দেশনেত্রী’ খ্যাতাব প্রাপ্ত বর্তমানে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার, আর গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের লড়াইয়ের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শোককে শক্তিতে পরিনত করে স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার প্রেরণার উৎস হয়ে রইবেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে । তিনি তাঁর ‘কোকোকে’ খুজেঁ পাবেন লক্ষ্-কোটি সন্তানতুল্য নেতা কর্মী আর দেশপ্রেমিক জনতার মাঝে।
লাখো জনতার উপস্থিতিতে আরাফাত রহমান কোকোর জানাজার পর যখন দেশের সকল প্রথম শ্রেনীর পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া লিড নিউজ করে ‘যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ’। ‘কোকোর জানাজা ঘিরে রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে’। তখন অনেক কষ্টের মাঝেও বুকটা ভরে যায়। বিজ্ঞানের একজন নগন্য ছাত্র হিসেবে বলতে পারি ‘এখনো যে বেঁচে আছি এটাই দূর্ঘটনা বরং মৃত্যুই অবধারিত’। সবাইকে এর সাথে আলিঙ্গন করতেই হবে। হোন না তিনি যত বড় জালিম আর স্বৈরশাসক, তাকেও! তবে সকল মৃত্যু সমান নয়, কোনো কোনো মৃত্যু গৌরবের আর কিছু মৃত্যু অপমানের। আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় লক্ষ্ লক্ষ্ দেশ প্রেমিক মানুষ উপস্তিত হয়ে আবারো জানান দিলো শহীদ জিয়ার বাংলাদেশে ‘জিয়া পরিবারই’ সেরা। জাগ্রত জনতা ফ্যাসিবাদের নাগের ডগায় চিৎকার করে বলে গেল ‘মা তুমি খালেদা দেশের সার্বভৌমত্ব আর গণতন্ত্র রক্ষার প্রেরণা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন শত বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে কোকোর জানাজায় ১০ লক্ষাধিক জনতার ঢল দেখে বর্তমান ফ্যাসিবাদের ভিতরে পতনের বিরহ সুর বাজতে শুরু হয়েছে। শোককে শক্তিতে পরিনত করে বিএনপি ও ২০ দলের নেতা কর্মীরাসহ দেশ প্রেমিক জনগণ জবরদখলকারী সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার আদায় করার মাধ্যমে গণতন্ত্র পূণ:প্রতিষ্ঠিত করে সকলের প্রিয় কোকো ভাইয়ের প্রতি প্রতিহিংসার জবাব দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর পূত্র শোককে শক্তিতে পরিনত করে দেশের গণ মানুষের নেত্রী খালেদা জিয়া দেশের আপামোর জনগণের আবেগাপ্লুত ভালবাসায় সিক্ত হয়ে সকলের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বললেন ‘গণমানুষের ভালবাসা জিয়া পরিবারকে আবারো কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ করলো’। তাই দেশের জনগনের অধিকার আদায়ে আপোষহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ এক ‘কোকো’কে হারালেও লক্ষ কোটি কোকোর প্রেরণার আঁধার।
লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।