ইসলামিক ফোরাম অফ ইউরোপের সাবেক সভাপতি, বৃটেনের প্রভাবশালী মুসলিম সংগঠন মুসলিম কাউন্সিল অফ বৃটেনের সাবেক সেক্রেট্রারী ড আব্দুল বারী হাফিংটনে পোস্টে
The ‘Islamic State’ Monstrosity: Can the Middle East Rise Up From the Ashes?
একটি কলাম লিখেছেন। কলামে ইসলামি ষ্টেট অফ ইরাক এন্ড সিরিয়া (আইসিস ) নিয়ে তার খোলামেলা মতামত প্রকাশ করেছেন । হাফিংটন পোস্ট থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন নাজমী নাতিয়া .
প্রাচীন সভ্যতার প্রানকেন্দ্র আরব বিশ্ব। ইব্রাহিম থেকে উদ্ভূত তিনটি ধর্মের জন্মস্থান এ অঞ্চলেই। অথচ এই এখানেই আস্তানা গড়ে নিচ্ছে ধাই ধাই করে বেড়ে ওঠা এক আতিকায় জন্ত, তথাকথিত ইসলামীক স্টেট (আইএস) হিসেবে যেটি পরিচিত। ব্রিটিশ বাচনভঙ্গিধারী এক ঘাতক দ্বারা মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলির শিরচ্ছেদ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এ জন্তুটি সর্বশেষ যে অনলাইন ভিডিওটি রিলিজ করেছে তা নিতান্তই জঘন্য। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা এ সংগঠনের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। প্রধান ব্রিটিশ মুসলিম পৃষ্ঠপোষকদানকারী সংগঠন, এমসিবি, এদের কাজগুলোকে ভারসাম্যহীন সহিংসতা বা psychopathic violence হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
আইএস এর নৃশংসতা এ অঞ্ছলে কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান নিষ্ঠুরতার কেবলমাত্র আরেকটি ভয়ঙ্কর সংযোজন। শত শতাব্দীকাল যাবত এখানকার গুরুত্বহীন শাসকদল, ক্ষমতালোভী সেনাবাহিনী এবং রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী স্বৈরাচারীরা নিজেদের লোকদের সাথে ধ্বংস খেলায় মেতে থেকেছে। প্রতিপক্ষকে হত্যা করে, শহর গুঁড়িয়ে দিয়ে, গ্রামগুলোতে বিষবাস্প প্রয়োগের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে দিনকে দিন ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে গেছে এরা। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি এরা করেছে বিদেশি শক্তিকে ঢুকতে দিয়ে, যার কারণে এ অঞ্চল এখন হয়ে উঠেছে যুদ্ধ আর অরাজকতার নাট্যশালা।
এগুলো মূলত শুরু হয়েছে অটোমান সাম্রাজ্যের সেই বেদনাদায়ক সামাজিক পতনের ফলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এদের জার্মানিকে দুর্ঘটনামূলক ভাবে সমর্থন করাটাও আরেকটি কারণ। ধসে পড়া অটোম্যানের প্রতি শিশুসুলভ রাজনৈতিক আচরণ আর আরবদের প্রচন্ড সুবিধাবাদি মনোভাবকেই পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ব্যবহার করে। আরব প্রদেশগুলোতে তারা সূক্ষ্মভাবে সমন্বয় ঘটায় অটোমানবিরোধী আন্দোলনের। একটি গোপন Sykes-Picot চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স আর ব্রিটেন কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অটোমান-আরব অঞ্চলগুলোতে কৃত্রিম সীমানা তৈরি করে নিজেদের ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসে। আর এভাবেই গড়ে ওঠে এক বিলাপরত আরব রাষ্ট্র।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুধু ব্যপক হারে মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে এসেছিলো। এ যুদ্ধ গভীর কূটকৌশলে আরব জনগনের মাঝে এক দীর্ঘমেয়াদি বিরোধের বীজ বুনে দিয়েছিল। সবচেয়ে খারাপ উদাহারন হিসেবে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক Balfour Declaration এর কথা আনা যেতে পারে যেটি ইহুদী এবং আরবদের মাঝে একটি জেনারেসনাল দ্বন্ধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্য সেই ১০০ বছর আগে যে বীজ বপন করা হয়েছিল তার ফল লাভ করায় ব্যতিব্যস্ত। সিরিয়া আর ইরাকে বাথিস্টদের সন্ত্রাসী রাজত্ব, সামরিক স্বৈরাচারের প্রতিনিয়ত মিশরীয় জনতার শক্তি নিঙরে নেয়ার নিদর্শন সহ রাজতান্ত্রিক গালফ রাস্ট্রগুলোর নৈতিক বিচ্যুতি(মাত্রা বিভিন্ন), এ সব কিছুর সাথে অবশ্যই ইউরোপিয়ান কলনিয়াল এন্টারপ্রাইস এর একটি যোগসূত্র রয়েছে যেটির মূল লক্ষই হল আরবের সম্পদ শুষে নেয়া।
ফিলিস্তিনি জনগণদের সাথে একটানা নিষ্ঠুর আচরণ আর আমেরিকা এবং এর জোটের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনে লালিত ইসরাইলের অবৈধ সেটেলমেন্ট সম্প্রসারণ প্রমাণ করেছে যে এটি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। ফি বছরে ইসরাইলি সৈন্যবাহিনীর মেশিন দিয়ে গাজায় যে প্রচন্ড হত্যাকান্ড চালানো হয় তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে এটি।
তবে, ভগ্ন আরবের গায়ে সর্বশেষ আঘাতটি লেগেছিল ২০০৩ সালে ইরাকে, আমেরিকার অবৈধ আক্রমণের কারণে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রবল আপত্তি সত্তেও তারা এ আক্রমন চালায়। অবিশ্বাস্য দাম্ভিকতা আর নিওকনজারভেটিভ এজেন্ডার চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে আমেরিকা ইরাকে সমস্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বর্জন করলো। এটি ছিল সাম্রাজ্যিক ঔদ্ধত্যতার সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত। আমেরিকার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা আর বর্বরতার জাতাকলে পরে এক কালের মুসলিম সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ইরাক ১২৫৮ এর মঙ্গলীয় অসভ্যতার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেল। বিশ্ববাসী সাক্ষী থাকলো হাজার মৃত্যুর, ধ্বংসযজ্ঞের আর একটি মানবগোষ্ঠীর লাঞ্চনাকর পরিস্থিতির। কি অবলীলায় জেনেভা কনভেনশনকে নিকুচি করে একটি অধিষ্টিত শক্তি গুঁড়িয়ে দিলো সবকিছু।
যখন পৃথিবীর একমাত্র শক্তিশালী জাতি “জোর যার মুল্লুক তার” নীতি গ্রহণ করলো অন্যত্র যে স্বৈরাচারী শক্তিগুলোর অবস্থান ছিল তারা প্রতিপক্ষকে ঠিক একই ভাবে ঘায়েল করার সুত্র আবিস্কার করে ফেললো। এর ফলে জঙ্গলের আইন অধিষ্ঠিত হয়ে গেল। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নৈতিকতার অভাব দেখা দিল, যে অভাব আমরা এখন প্রতিনিয়ত অনুভব করছি।
আইএস এর নিকৃষ্ট দানবীয় রুপ,যেটিকে না ইসলামিক না রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়া যায়, আমাদের সবাইকে আতঙ্কগ্রস্থ করেছে। সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে, হত্যা করে আর বিদ্রোহী ছবি অনলাইনে পোস্ট করে এই সংগঠনটি প্রচার ও প্রসারের অস্ত্র তুলে দিচ্ছে চারিদিকে সব ইসলামফোবসদের হাতে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে আইএস এর একটি অংশ স্বাধীন ইরাকের ওপর আমেরিকা যে নিষ্ঠুর ও অনৈতিক আক্রমণ চালিয়েছিলো তার বাই প্রোডাক্ট। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের আক্রমণের পরপরিই আল কায়েদার যেভাবে জন্ম আইএসেরও ঠিক একইভাবে।
সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিকে কেন্দ্র করে ইরাক আর সিরিয়াকে ভয়াবহ সব বদলি যুদ্ধ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যদিও শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে ঐতিহাসিক, পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক পার্থক্য আছে। কিন্তু তা থাকা সত্ত্বেও মুসলিমবিশ্বকে ইউরোপের মত খ্রিস্টধর্মে বিদ্যমান দুই শাখাকে উৎস করে মধ্যযুগে যে ভীষণ রক্তক্ষরণ হয়েছিলো তা দেখতে হয়নি। চলমান যে শিয়া-সুন্নি সহিংসতা চলছে, যেটি অবশ্যই আজকের আরব বিশ্বের পতনের একটি অন্যতম কারন, এর পেছনে কোন অশুভ ছায়া কাজ করছে। বিদেশী আধিপত্যই এখানে প্রভাব ফেলছে।
কোন মানুষই আমেরিকা এবং এর সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে আশা করেনা যে তারা এসে আরবদের এই চলমান দুর্বিপাক থেকে উদ্ধার করবে। কিন্তু এই বিশ্ব ক্ষমতাধরেরা নিজেদের জাতিগত স্বার্থের কারনেই পারস্পরিক সম্পর্কের এ পৃথিবীতে অতীতের ভুলকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চায়না। প্রতিবেশীদের শূন্য করে দেয়া শুধু অনৈতিকই নয় বরং পরিশেষে এটি পাল্টা ফলাফল আনতে সক্ষম। আরবের অঞ্চলগুলো মধ্য প্রাচ্যের নীতি নির্ধারণে কিছুটা হলেও নৈতিকতা প্রত্যাশা করে আমেরিকা ও তার বন্ধুদের কাছ থেকে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে যে আমেরিকা শুধু দুই নৌকায় পা দিয়েই বেড়াচ্ছে। ইরাকে যত সাধারণ মানুষ মরছে আই এসের হাতে সেসব মানুষের রক্তের সাথে গত বছরে কায়রোর রাবা ম্যাসাকারে নিহত নিস্পাপ মানুষগুলোর রক্তের কি কোন পার্থক্য আছে?
ইরাক দেশি বিদেশী চাপের মুখে চেস্টা করছে একটি অভিন্ন সরকার গঠন করতে। লক্ষ রাখতে হবে যে আমেরিকা এবং এর বন্ধু মহাদয়গন যেন কোনভাবেই তাদের মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার নাম করে আরেকটি ভয়াবহ মিশন প্রেরন না করে।
আমেরিকা এখনো একটি অপ্রতিরোধ্য সার্বজনীন সামরিক শক্তি। অতিরিক্ত কিছু বাধ্যবাধকতা এদের ওপর চাপিয়ে দেয়া বিশ্ব শান্তির প্রয়োজনে। যেভাবে বৈশ্বিক শক্তির চাকা ঘুরছে আমেরিকা খুব শীঘ্রই আধিপত্য হারাবে কারণ সাধারণ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী খুব বেশীদিন পর্যন্ত ইতিহাসের ভুল দরজায় কেউ অবস্থান করতে পারেনা।
এদিকে আরব বিশ্বও সারাজিবনের জন্য বিপজ্জনক অবস্থায় থাকবেনা। তাদের অনন্য ও উন্নত ধার্মিক ঐতিহ্য আছে যা তাদের সাহায্য করবে উঠে দাঁড়াতে। তাদের আছে নিজেদের ভাগ্য সবচেয়ে কঠিন সময়েও নিজেদের হাতে নতুন করে গড়ার ইতিহাস। এখন খুব সম্ভবত তাদের বেশি প্রয়োজন নতুন করে বিশ্বস্ত নেতৃত্বের জন্ম দেয়া যারা দূরদর্শিসম্পন্ন, বিচক্ষণ ও রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবের কারণে তাদের ২০১১ এর আরব বসন্তের মত সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল তার সাথে সাথে চক্রান্তমূলকভাবে ন্যস্ত কিছু স্বার্থের কারণে সব বিকিয়ে দিতে হল। কিন্তু একদিন তারা আবার জেগে উঠবে। শত সহস্ত্র বছরের গঞ্জনা আর অপমান থেকে নিজেদের মুক্ত করবে নিশ্চয়ই। আশা করা জায় সেদিন খুব দুরের না।
হয়ত মধ্যপ্রাচ্যের সুরুঙ্গ শেষে এখনি কোন আলোর বিচ্ছুরণ চোখে পরবেনা। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। জঞ্জাল পেছনে ফেলে নব শক্তির উত্থানের আর দেরি নেই সত্যি।