সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাকের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিল কয়েকটি গবেষণার ফলাফল। গবেষণার মূল বিষয় ছিল ‘দ্য স্টেট অব গভর্নেন্স বাংলাদেশ ২০১৩, ডেমোক্রেসি পার্টি পলিটিকস’। দেশের ও বিদেশের কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তির ডেমোক্রেসি ও পার্টি পলিটিকসের আনুষঙ্গিক বহু বিষয় নিয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। যার মধ্যে প্রধান দুটি বিষয় ছিল গণতন্ত্র ও দলীয় রাজনীতি। এক. দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, দুই. দলের অর্থায়ন, যাকে আমরা সহজ ভাষায় রাজনৈতিক অর্থায়ন বলে জানি।
মূলত এ গবেষণার তথ্য-উপাত্তের উৎস দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ গবেষণা দেশের অন্যান্য দলের অভ্যন্তরীণ এই দুটি বিষয় খুব প্রাধান্য পায়নি। অন্য দলের অভ্যন্তরে উঁকি দিলেও হয়তো একই ধরনের চিত্র ফুটে উঠত।
ওই সেমিনারের সপ্তাহ খানেক পর একই প্রতিষ্ঠান তাদের উল্লিখিত গবেষণার একটি সমষ্টিগত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরে। তাদের গবেষণাপত্র আলোচিত দুটি বিষয়ে তেমন নতুন তথ্য তুলে ধরেনি, তবে বিস্তারিতভাবে আলোচনা, গবেষণালব্ধ ফলাফল দেশে-বিদেশে বিদগ্ধজনের সামনে এবং এ বিষয়ে যাঁরা আরও গবেষণা করতে চাইবেন, তাঁদের নতুন খোরাক জোগাবে।
আমি ওই গবেষণাপত্রের একটি দিক নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা করতে চাই। বিষয়টি যেকোনো দেশের গণতন্ত্রের ও গণতন্ত্রকামী জনগোষ্ঠীর
জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি হলো দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা। বিষয়টি বহু চর্চিত, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপিত হওয়ায় আলোচনার
দাবি রাখে। ওই গবেষণাপত্র মোতাবেক আমাদের দেশের বৃহত্তর দল দুটির মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার একান্ত অভাব রয়েছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে গঠনতন্ত্র রক্ষার জন্য সামান্য আলোচনা হলেও বিএনপিতে এ বিষয়ে তাদের গঠনতন্ত্র তেমন সুবিন্যাসিত নয়। আগেই বলেছি, অন্যান্য দল নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে দু-একটি ছোট দলে কিছুটা গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শিত হলেও কার্যত দৃশ্যমান নয়। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের কোনো দলেই ভাঙন ব্যতিরেকে গত ৩০ বছরে দলের শীর্ষ পর্যায়ে তো নয়ই, এমনকি তৃণমূল পর্যায়েও কোথাও নেতার পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা যায়নি। যা-ও হয়, তা-ও গণতান্ত্রিক পন্থায় নয়। কেন্দ্রের বাইরে ও উত্তরাধিকারসূত্রে নেতার পরিবর্তন হতে দেখা যায়।
দলের অভ্যন্তরের গণতন্ত্র নিয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিদের যেসব গবেষণা রয়েছে, তাতে দুটি প্রধান উপাদানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি বহুমাত্রিক, অন্যটি বিকেন্দ্রীকরণ। এই দুটি বিষয়ই দলের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বহুমাত্রিকের ব্যাখ্যায় যা প্রতীয়মান, তা হলো দলের ভেতরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বলয়টি কতখানি বিস্তৃত, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সর্বজনবিদিত হতে
হয় এবং নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কিছুটা কেন্দ্রিক হতে হয়। বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পার্টি, পার্টি-সমর্থক ও বিভিন্ন জনজীবনের মানুষের চিন্তাধারার সংমিশ্রণ হয়ে থাকে। নেতৃত্বের বদল হয় একটি নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে এবং সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে জাতীয় সম্মেলন বা কাউন্সিলের জন্য তিন বছর সময় নির্ধারিত থাকলেও বিএনপির সাংগঠনিক গঠনতন্ত্রে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। ২০০৯ সালের আগে বহু বছর দুই দলের জাতীয় কাউন্সিলে সমাবেশই হয়নি।
যা হোক, ওপরে দুটি মূল উপাদানের কথা উল্লেখ করেছি। তা ছাড়া পণ্ডিতদের মতে, ওই আলোকে দলের অভ্যন্তরের গণতন্ত্র নিশ্চিত
করতে আরও যা প্রয়োজন সেগুলো হলো, অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা, প্রতিনিধিত্ব, প্রতিযোগিতা, দায়িত্বশীলতা ও স্বচ্ছতা। মোদ্দা কথা, পার্টির নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাধারণ সদস্য থেকে বিভিন্ন পদের সদস্যদের কতখানি অংশগ্রহণের সুযোগ দলের অভ্যন্তরে রয়েছে, সে বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ছাড়াও আরেকটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার।
দলের গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান প্রতিনিধিত্ব, তা যে পর্যায়েই হোক না কেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পর্যায়ে দলের প্রতিনিধিত্বকারীর বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রায়ণ, আমরা সহজ ভাষায় যাকে বিভিন্ন নির্বাচনে, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন-প্রক্রিয়া মনে করি। এই মনোনয়ন-প্রক্রিয়া হতে হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৃণমূল পর্যায়ের এবং দলীয় সমর্থকদের অংশগ্রহণে, নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বমুখী। প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে, যেখানে পার্টি গণতন্ত্র প্রশ্নাতীত, যেসব দেশে এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ ও প্রতিনিধিত্বমূলক। এ বিষয়টি পার্টির ও দেশের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রথম পর্যায় থেকেই স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততা থাকলে দেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে সমস্যা হয় না।
আমি সংক্ষেপে ওপরে তাত্ত্বিক আলোচনা করলাম। তাত্ত্বিক হলেও পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের জন্য এসবই অপরিহার্য। এখন প্রশ্ন থাকে যে পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব কার বা কোন প্রতিষ্ঠানের? এর উত্তর হচ্ছে, প্রধানত দলের এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, এমনকি হতে পারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দ্বারা নিশ্চিতকরণ।
বিশ্বের বহু দেশে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন আইন এবং নির্বাচনবিষয়ক আইনের মাধ্যমে পার্টি গণতন্ত্র নিশ্চিত করার বিধান রয়েছে। এসব দেশে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পার্টির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বিশ্বের অনেক দেশে পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিষয়টি সংবিধানেও উল্লেখ রয়েছে। তবে সিংহভাগ দেশে, বিশেষ করে যেসব দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি উচ্চমার্গের, সেসব দেশে পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিষয়টি পার্টির গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপরই নির্ভর করে।
যেমনটা আগেই বলেছি যে পার্টির অভ্যন্তরের গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান পার্টির তথা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রার্থী মনোনয়নের পদ্ধতি। এ পদ্ধতি হতে হবে প্রতিনিধিত্বমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে তৃণমূল পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রতিফলিত হবে। প্রায় সব দেশেই প্রাথমিক নির্বাচনের মাধ্যমে নমিনেশনের জন্য প্রার্থী বাছাই করা হয়। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেও বহু দেশে আইন অথবা সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বাস্তবিক উদাহরণ জার্মানি। ওই দেশে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন, গণতন্ত্র, নেতা নির্বাচন, প্রার্থী নির্বাচনের বিষয়টি ও প্রক্রিয়া সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।
সংবিধানের বাধ্যবাধকতার বাইরে নির্বাচন কমিশনের আইনের মাধ্যমেও পার্টির গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করার বিষয়টি রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। নিবন্ধনকারী দলকে দলের অভ্যন্তরে আলোচিত পদ্ধতিতে গণতন্ত্রের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন পার্টির গঠনতন্ত্র মোতাবেক বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনের বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রয়োজনে তাগিদ দেওয়ার এখতিয়ার রাখে।
আগেই আলোচনা করেছি যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআইজিডির গবেষণা প্রতিবেদনে গণতন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে একধরনের হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যদিও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ, ১৯৭২-এর ২০০৮ সালে অধিকতর সংস্কারে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করার কিছু বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছিল। প্রথমত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরাসরি না হলে দলের কাউন্সিল অধিবেশন ও নতুন গঠিত সর্বস্তরের নেতাদের, বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ের কমিটিগুলোর বিবরণ দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে এটা অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। যদিও ২০০৮ সালের আইন সংস্কারের সময় অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের সুপারিশ করা হলেও বড় দলসহ প্রায় দলই সমর্থন ওই সুপারিশ করেনি।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন পদ্ধতিকে স্বচ্ছ করার জন্য বহু দেনদরবার করে যতটুকু আইন করা হয়েছে, তারও সঠিক প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে মনে হয় না। সুপারিশ করা হয়েছিল গোপন ভোটের মাধ্যমে মনোনয়ন-উপযোগী প্রার্থী বাছাই করা, কিন্তু তার পরিবর্তে তৃণমূলের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা আইনে সন্নিবেশিত থাকলেও বড় দলগুলোসহ কোনো দলই তা অনুসরণ করছে না। ২০০৯ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কিছুটা প্রয়াস নিলেও পরবর্তী সময়ে সেটুকুও পরিলক্ষিত হয়নি। বর্তমানে কোনো দলই মনোনয়ন প্রদানে স্বচ্ছ থাকছে না, এমনকি বিদ্যমান আইনও অনুসরণ করছে না। এমনকি মনোনয়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তিন বছর প্রাথমিক সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতাও (আরপিও: ১২ (১)(জে): ২০০৯) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বিলুপ্ত করা হয়েছে। বর্তমানে নির্বাচনী আইনে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিষয়ে যতটুকু রয়েছে, তার প্রতিপালনও সঠিকভাবে হচ্ছে না।
ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে আমাদের দেশের বড় দুটি দলসহ অন্যান্য দলের মধ্যেও প্রকৃত গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক দলের মধ্যেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, সে দেশে রাজনৈতিক দলের শাসনে কতখানি গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হতে পারে, তা অনুমেয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত, দলগুলো যা প্রচার করে, তা প্রথমে নিজেদের মেনে চলতে হবে। দেশে টেকসই গণতন্ত্রচর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রয়োজনে আরও বিস্তারিত আইন প্রণয়ন অথবা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার চিন্তাভাবনা করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের এবং জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সংসদের। দেশের সর্বস্তরের জনগণ সঠিক গণতন্ত্রের প্রত্যাশী এবং দলগুলো থেকেও তেমনটি প্রত্যাশা করে।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
( প্রথম আলো )