ভাসুর ও জাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন। সে দায়েই এখন কারাগারে বন্দি আছেন কানাডাপ্রবাসী সিদরাতুল মুনতাহা চৌধুরী। তবে চাঁদাবাজি নয় মুনতাহা চৌধুরী এখন আলোচনায় তার উদ্দাম ও বেপরোয়া জীবনাচারের কারণে। পুলিশের খাঁচায় বন্দি হওয়ার পর একে একে বেরিয়ে আসছে তার অন্ধকার জীবনের ‘ফুল স্টোরি’। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া গল্পের বাইরেও আরও অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে।
সিদরাতুল মুনতাহা চৌধুরী। ডাক নাম ফুলি। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কাদিমল্লিক গ্রামের মইজ উদ্দিন চৌধুরীর মেয়ে। পড়ালেখা করেছেন সিলেটের ব্লু বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার আগেই ২০০৭ সালের ১৫ই ডিসেম্বর পরিবারের পছন্দে মায়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে কানাডাপ্রবাসী মাহবুব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মাহবুব চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার রফিপুর গ্রামে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে কানাডায় চলে যান ফুলি। প্রথম প্রথম ভালই চলছিল। প্রবাসের রঙিন জীবন রঙ ধরায় ফুলির মনেও। একটু একটু করে আলো-আঁধারির ছায়া পড়ে তার মাঝে। ফুলি বেপরোয়া হতে থাকেন পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে। খরচ বেড়ে যায় তার। স্বামীর কাছে আবদার কেবল বাড়তে থাকে। হিসাব মেলাতে হিমশিম খান কানাডার ‘মণিমহল’ রেস্টুরেন্টে কর্মরত মাহবুব চৌধুরী। কিছুই বুঝতে চান না ফুলি। বিলাসী জীবনের খরচ মেটাতে তার শুধু টাকা চাই। টাকার জন্য বেপরোয়া ফুলি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। স্বামীর ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৮০ হাজার ডলার আত্মসাৎ করেন। তার স্বামী যে রেস্টুরেন্টে কাজ করেন সেই মণিমহলের মালিক দেওয়ান শাহীনেরও ৬০০০ ডলার কবজায় নেন চেক জালিয়াতি করে। স্ত্রীকে নিয়ে যেন আর পারছিলেন না মাহবুব চৌধুরী। একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে সিলেট নগরীর উপশহরস্থ ফ্ল্যাট বিক্রির ‘দায়িত্ব’ দিয়ে দেশে পাঠান স্ত্রীকে। তবে মাহবুব চৌধুরী ভাবতে পারেননি দেশে এসে আরও ভয়াবহ ‘কীর্তিগাথা’র জন্ম দেবেন ফুলি।
৫ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ফুলি দেশে আসেন গত ১৫ই মার্চ। সেদিন ছিল মাহবুব চৌধুরীর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। দেশে ফিরে ফুলি ওঠেন নগরীর ফাজিল চিশতে তার পিতার বাসায়। কানাডা থেকে মনে যে রঙ লাগিয়ে এসেছিলেন তার প্রলেপ থেকে যায় দেশে আসার পরও। দেশে ফিরেও বেপরোয়া চালেই চলতে থাকেন। বাইরে বাইরেই সময় কাটতো বেশি। কেউ কৈফিয়ৎ চাইলে বলতেন ‘ফ্ল্যাট বিক্রি’র চেষ্টার জন্যই বাইরে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিনই বাসা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বের হতেন। হাতের টাকা শেষ করে তবেই ফিরতেন বাসায়।
ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, আনন্দফুর্তি ফুলির জীবন যেন এমনই। কেনাকাটার সূত্রে পরিচয় হয় অলঙ্কার প্রতিষ্ঠান জেমস গ্যালারির নয়া সড়ক শাখায় কর্মরত দিলদার হোসেন ওরফে নাজমুলের সঙ্গে। বিনিময় হয় দু’জনের মোবাইল ফোন নাম্বার। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার রেহানউল্লার ছেলে নাজমুলের কাছে ফুলি পরিচিত হন ‘খুশি’ নামে। পরিচয়ের পরদিনই মেন্দিবাগের একটি হোটেলে লাঞ্চ করেন তারা। ফুলি প্রথম দিকে নিজের বিবাহিত পরিচয়টি আড়াল করেন নাজমুলের কাছে। তবে এক সময় নাজমুল জানতে পারেন বিষয়টি। ফুলি বিষয়টি স্বীকার করেন, তবে আংশিক। বলেন, এক বছর আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ‘আগের স্বামী’র সঙ্গে। আগের বৃত্তান্ত জানাজানির পরও সম্পর্কে ভাটা পড়েনি এতটুকু। বরং আরও গভীর হতে থাকে সে সম্পর্ক। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তারা। ডিভোর্সের কাগজ ছাড়া কাজী বিয়ে পড়াতে রাজি না হলে ২৫শে জুন মৌলভী ডেকে একে অপরকে ‘কবুল’ করেন তারা। ফুলির বেপরোয়া জীবন আরও গতি পায়। পার্টি, মদ, ড্যান্স সব কিছুরই স্বাদ নিতে থাকেন তারা। নাজমুলের মাধ্যমে ফুলির পরিচয় হয় জুবায়ের, লিজা, উজ্জ্বল, কুটি, রিপন আলীর সঙ্গে। এদের সবার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন ফুলি। ফুলির নেতৃত্বে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এ বাহিনী। এমনকি ফুলিকে কেন্দ্র করে সাগরদীঘির পারের জনৈক ফাহাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে নাজমুল বাহিনী। এই ফাহাদের বাসাতেই ভাড়া থাকতেন ফুলি-নাজমুল।
ফুলির বিলাসী জীবন টানতে কেবলই টাকার প্রয়োজন। তাই নানা ধরনের প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে তারা। ভিসা প্রসেসিংয়ের কথা বলে নগরীর সুবিদবাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। চাঁদা চেয়ে ফোন করে সুবিদবাজারেরই আরও এক ব্যবসায়ীর কাছে। এতেও মন ভরছিল না ফুলির। মোটা একটা ‘দান’ মারতে নাজমুলের হাতে নিজের ভাসুর বেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও জা মাহবুবা নোমান চৌধুরীর ফোন নাম্বার তুলে দেন। তবে সাহস করতে পারছিলেন না নাজমুল। নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন ফুলিকে। কিন্তু কিছুতেই তাকে বোঝানো যাচ্ছিল না। উল্টো আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে ফুলিই চাপে ফেলেন নাজমুলকে।
২৮শে আগস্ট ২০১৪। সেদিন ছিল দিলদার হোসেন নাজমুলের জন্মদিন। ফুলি নাজমুলের বন্ধুদের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে নগরীর নয়া সড়কস্থ সিলভার প্যালেস রেস্টুরেন্টে একটি পার্টির আয়োজন করেন। পার্টি শেষে সন্ধ্যায় সবাই মিলে রোজভিউ হোটেলে নেশার আসরে যোগ দেন। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাজমুল উল্লেখ করেন, নেশার ফাঁকে বারবার ফুলি তার ভাসুর বেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও জা মাহবুবা নোমান চৌধুরীর কাছে চাঁদা চেয়ে ফোন দিতে চাপ দেন। দু’জনের মাঝে এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে চাঁদা চেয়ে ফোন দেন নাজমুল। মাহবুবা নোমানের কাছে ফোন করে দাবি করেন ১০ লাখ টাকা। হুমকি দেন টাকা না দিলে অপহরণ করে হত্যা করা হবে তাকে ও তার ছেলেকে। ফোনে টাকা দাবি না করলে হয়তো জানা হতো না ফুলির পেছনের গল্পগুলো।
ফোন পেয়ে আতঙ্ক ভর করে মাহবুবা নোমানের মনে। নিজের চেয়ে ছেলের জন্য বেশি ভয় তার। হুমকি অব্যাহত থাকায় বন্ধ করে দেন ছেলের স্কুল যাওয়া। শুধু মাহবুবা নোমানের কাছে নয়, ফোন যায় কানাডায় তার স্বামী বেলাল চৌধুরীর কাছেও। হুমকি দেয়া হয় দেশে এলে তাকেও হত্যা করা হবে। চাঁদা দাবি করা হয় একই অঙ্ক ১০ লাখ টাকা। আতঙ্কিত মাহবুবা নোমান চৌধুরী জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে কোতোয়ালি থানায় দু’টো সাধারণ ডায়েরি করেন। প্রথমটি ২৮শে আগস্ট (নং ১৬৯১)। এক মাস অপেক্ষা করে ফল না পেয়ে দ্বিতীয় সাধারণ ডায়েরিটি করেন ২৬শে সেপ্টেম্বর (নং ২১০৩)। প্রতিকার মেলেনি এর পরও। ফোনে হুমকি অব্যাহতই থাকে। নিরুপায় হয়ে শরণাপন্ন হন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের। ইতিমধ্যে বিষয়টি জানান কানাডা দূতাবাসে, উদ্বিগ্ন হয় দূতাবাসও। দূতাবাসের পক্ষ থেকে কনসুলার অফিসার ডুরেন রহমান নিরাপত্তা চেয়ে যোগাযোগ করেন পুলিশের সঙ্গে। এক পর্যায়ে তদন্তে নামেন গোয়েন্দারা। খুঁজে বের করেন পেছনের হোতাদের। বেরিয়ে আসে এমন গল্প যা কারও ধারণাতেই ছিল না।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ফুলি শুধু নাজমুলের সঙ্গেই নয় সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন আরও অনেকের সঙ্গে। নাজমুলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেই নাজমুলের বন্ধু রিপনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন ফুলি। এ নিয়ে নাজমুলের সঙ্গে তার টানাপড়েনও তৈরি হয়। ফুলির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় নাজমুলের। রিপন আরও কাছে আসেন ফুলির। গত ১৩ই নভেম্বর মালাবদল করেন ফুলি ও রিপন। সে বৃত্তান্তও সবার কাছে অজানা থাকে। হঠাৎ একদিন মেয়ের ব্যাগ খুললে এ বিয়ের কাবিন দেখতে পান ফুলির মা রত্না খানম চৌধুরী। চমকে ওঠেন, মেয়ে যে বখে যাচ্ছে তা টের পেয়েছিলেন। তবে এতটা যে ঘটে গেছে কল্পনাতেও ছিল না। ফোন দেন রিপনের কাছে। রিপন দৃঢ় কণ্ঠে স্বীকার করেন ফুলি তার স্ত্রী। আদালতে নাজমুল যে জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে জানা যায়, ২০১৩ সালে আরিফ নামে ঢাকার বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গেও বিয়ে হয়েছে ফুলির।
বল্গাহীন জীবনাচারের কুশীলবরা এখন পুলিশের খাঁচায়। লাল দালানে বন্দি রঙিন জীবনের নায়ক-নায়িকারা। সিলেট মেট্রো পুলিশের গোয়েন্দা জালেই শেষমেষ ধরা পড়ে তারা। পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত তদারক করেন সহকারী কমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী। তদন্তের ভার ছিল গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক মো. মোশাররফ হোসেনের ওপর।