ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটসহ সারা দেশে দুই শতাধিক ডাকাতি। এসব ডাকাতি সংঘটন করতে গিয়ে ১২টি খুন। আর, ছিনতাইয়ের কোনো হিসাবই নেই। ২০০৯ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে একজনের হাতেই ঘটেছে এতসব দুর্ধর্ষ অপরাধের ঘটনা। সিনেমার কাহিনিকে হার মানানো সেইসব দুর্ধর্ষ ঘটনার নায়ক ইমতিয়াজ উদ্দিন বাবুল। গত ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নিউমার্কেটের সামনে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির মূল হোতা।
এতসব দুর্ধর্ষ অপরাধ সংঘটনের পরও এর আগে ঢাকা ও মাগুরায় মাত্র দুবার গ্রেফতার হয়েছেন বাবুল। সবশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে পালানোর সময় বিদেশি পিস্তলসহ তৃতীয়বারের মতো গ্রেফতার হন এই দুর্ধর্ষ ডাকাত। বর্তমানে কোতোয়ালি থানা-পুলিশের হেফাজতে চার দিনের রিমান্ডে রয়েছেন তিনি। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে গত পাঁচ বছরে দুই শতাধিক চাঞ্চল্যকর ডাকাতির রোমহর্ষক কাহিনি।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে ঢাকার গুলশানে আমিন জুয়েলার্সে দিনদুপুরে ডাকাতি করতে গিয়ে তিনি প্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এর আগে, একই বছর জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় একটি জুয়েলারিতে ডাকাতি করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন বাবুল। এ সময় পুলিশ তাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেও ঠিকানা উদ্ধার করতে না পেরে গ্রেফতারে ব্যর্থ হয়। তবে সেই মামলায়ও আদালতে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালে প্রথম গ্রেফতার হয়ে ২০১২ সালে জেল থেকে জামিনে মুক্তি পান বাবুল। এর কিছুদিন পর ২০১৩ সালের ১১ মার্চ যশোরে একটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রসহ মাগুরায় গ্রেফতার হন। চলতি বছরের ৪ নভেম্বর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। এর এক মাসের মাথায় চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে ডাকাতির পরিকল্পনা করে আবারও অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন।
চট্টগ্রামে ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি ও গ্রেফতার
বাবুল ডাকাত পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি জেল থেকে বের হয়েই পুনরায় ডাকাতির প্রস্তুতি নেন। চট্টগ্রামে এসেই বাবুল ব্যস্ততম জনবহুল নিউমার্কেট সংলগ্ন জিপিওর সম্মুখস্থ আলকরণ এলাকার মুখে পাশাপাশি অবস্থিত নিউ গিনি গোল্ড এবং অপরূপ জুয়েলার্স নামের দুটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। এ জন্য তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে তার দলের ১১ জনকে একত্র করে ডাকাতির সবশেষ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। এ জন্য ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয় হাতবোমা ও অস্ত্র। ডাকাতির আগের দিন ওই দুই স্বর্ণের দোকানের সামনের অবস্থা সরেজমিন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি, অপরূপা জুয়েলার্স থেকে একটি স্বর্ণের নাকফুল কিনে নিশ্চিত হন যে, দোকানের সামনের শো-কেসে সাজিয়ে রাখা অলংকারগুলো সব স্বর্ণের।
পরদিন ১৩ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে মাইক্রোবাসযোগে ১০ সঙ্গীকে নিয়ে তিনি হানা দেন ওই দুই দোকানে। লক্ষ্য অনুযায়ী শো-কেস ভেঙে স্বর্ণ নেওয়ার চেষ্টা করলে সেখানে অলংকার না থাকায় দোকানের মালিককে আঘাত করে ভল্টের চাবি দাবি করেন। এ সময় বাইরে অপেক্ষমাণ সহযোগীরা হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটালে দলের এক সহযোগীর হাতে থাকা বোমাভর্তি ব্যাগ পুরোপুরি বিস্ফোরিত হয়ে দুই সহযোগীও বোমায় আহত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। এ অবস্থায় আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসতে শুরু করলে, স্বর্ণ না নিয়েই পালানোর পথ খুঁজতে থাকে দলের সদস্যরা। এ সময় স্বর্ণের দোকানের ভেতরে থাকা বাবুল দ্রুত বের হয়ে জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যান এবং সদরঘাট রোড হয়ে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশাযোগে সাগরিকা ক্রিকেট স্টেডিয়াম এলাকায় চলে যান।
এদিকে, এরই মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সমগ্র মহানগরীতে রেড অ্যালার্ট জারি করে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করে। রাত পৌনে ১০টার দিকে নগরীর সাগরিকা রোডস্থ জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের সামনে এমনই এক চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করেন পাহাড়তলী থানার অফিসার ইনচার্জ এ কে এম আজিজুর রহমান। এ সময় চেকপোস্ট দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার দুই আরোহী। এ অবস্থায় পুলিশ ধাওয়া করে একজনকে আটক করতে সক্ষম হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলিভর্তি একটি ম্যাগজিন। পরে পুলিশ নিশ্চিত হয় এই ব্যক্তিই স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির মূল হোতা দুর্ধর্ষ ডাকাতসর্দার ইমতিয়াজ উদ্দিন বাবুল। তার নেতৃত্বে এ ডাকাতির সময় ফুটপাতের এক খুদে ব্যবসায়ী নিহত হয় এবং আহত হয় কমপক্ষে ১৪ জন।
২০০ ডাকাতি, ১২ খুন, কয়েক শ ছিনতাই
গ্রেফতারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল তার অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার বয়স ৪৯ বছর। পিতার নাম মৃত মোহাম্মদ আলী শেখ, গ্রাম- খালখোলা, থানা- মোরেলগঞ্জ, জেলা- বাগেরহাট।
বাবুল জানান, ২০০৩ সালে তিনি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামে এসে ট্যাক্সি চালানো শুরু করেন। এরপর, একপর্যায়ে তিনি ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে কয়েক শ ছিনতাই করলেও পুলিশ একবারও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি বলেও দাবি করেন বাবুল। এরপর ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ডাকাতি শুরু করেন তিনি। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় ডাকাতির পর তার নাম জানতে পারে পুলিশ। এরপর তিনি পালিয়ে ঢাকায় চলে গিয়ে সেখানেও ডাকাতি শুরু করেন। ঢাকার মিরপুরে বাণী জুয়েলার্স নামের একটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে কোটি টাকার স্বর্ণ লুটে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি।
পুলিশকে বাবুল জানিয়েছেন, তিনি ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কতগুলো ডাকাতি করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। তবে এই সংখ্যা ২০০-র বেশি হবে বলে দাবি করেন তিনি। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ১২ জন খুন হয়েছে বলেও স্বীকার করেন বাবুল। আহতের সংখ্যাও অনেক। আর, ছিনতাই করেছেন অসংখ্য। এর আগের দুবারে গ্রেফতার হয়ে প্রথমবার তিন বছর এবং দ্বিতীয়বার এক বছরের কিছু বেশি সময় কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে।
ডাকাতির টাকায় পাকা দালান
বাবুল পুলিশকে জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে ঢাকার বাণী জুয়েলার্সে ডাকাতি করে নিজের ভাগে প্রায় ৩০ লাখ টাকা পেয়েছেন। সে টাকায় গ্রামে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সে বাড়িতে এখন তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানরা বসবাস করছেন। চট্টগ্রামে অবস্থানকালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করলেও সে স্ত্রী এখন সঙ্গে নেই।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিন সেলিম জানিয়েছেন, ইমতিয়াজ উদ্দিন বাবুল তার দুর্ধর্ষ সব ডাকাতির কাহিনি ইতিমধ্যে স্বীকার করেছেন। ঢাকার গুলশানে আমিন জুয়েলার্স এবং মিরপুরে বাণী জুয়েলার্সসহ চট্টগ্রামে একাধিক বড় বড় ডাকাতি সংঘটিত করার কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
ওসি জানান, ডাকাত বাবুলের নেতৃত্বে কমপক্ষে ৪০ জনের একটি দল রয়েছে। এ ছাড়া আলাদাভাবে রয়েছে অস্ত্র, বোমা ও তথ্য সরবরাহকারী। এই চক্রের সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।