মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ কার্যকরের সময় নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, অনেক আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বুধবার অথবা বৃহস্পতিবার রাতেই ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছিলো সরকার। আর এমন সিদ্ধান্ত থেকেই বুধবার আইনমন্ত্রী কারা কর্তৃপক্ষকে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণেই শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, মঙ্গলবার কাশিমপুর থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানকে নিয়ে আসা এবং ওই দিন রাতেই অনুষ্ঠিত ফাঁসির মহড়া দেওয়ার প্রাপ্ত আদেশ থেকে আইজি প্রিজন বুঝতে পেরেছিলেন জেলকোড না মেনেই সরকার রায় কার্যকর করতে যাচ্ছে।
কিন্তু সরকার তাড়াহুড়া করে ফাঁসি দিলে জেলকোড অনুসরণ না করার এই দায় কারা কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে এমন আশঙ্কা থেকেই বুধবার দুপুরে আইনমন্ত্রীর কাছে ছুটে যান আইজি প্রিজন।
সচিবালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তারা। এসময় জেলকোড না মেনে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে আপত্তি জানান আইজি প্রিজন।
একটি সূত্র জানায়, আইজি প্রিজনের এমন আপত্তির পরপরই জেলকোডসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছুটে যান আইনমন্ত্রী।
এদিকে এটর্নি জেনারেলসহ সরকার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মাঝে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো যে, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ, রিভিউ এবং জেলকোড না মেনে তড়িঘড়ি করে সরকার কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করতে পারে।
ওই আশঙ্কা থেকে এ দিন দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের উদ্যোগের প্রতিবাদ জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে কামারুজ্জামানের সাংবিধানিক অধিকার উপেক্ষা করেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে আইন বহির্ভূতভাবে তাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ তোলেন আইনজীবীরা।
এরপর সন্ধ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার গুলশানের বাসায় এসব অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটা রায় আছে, সেখানে রিভিউ পিটিশন ডিসমিস হয়েছে, সেটা ধরে নিয়ে আমাকে আদেশ দিতে হবে জেল কর্তৃপক্ষকে, তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে, আমি সেই আদেশ দিয়েছি।’
কামারুজ্জামানকে দণ্ডাদেশের রায় জানানো হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন আমি আইজি প্রিজন সাহেবকে করি নাই। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, তাঁকে (কামারুজ্জামান) জানানো হয়েছে..।’
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইনানুগভাবে যে মুহূর্ত থেকে কামারুজ্জামান জানবেন আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে সেই মুহূর্ত থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার সময় গণনা শুরু হবে। আর এক্ষেত্রে তিনি সাতদিন সময় পাবেন।’
জানা যায়, আইনমন্ত্রী রায় কার্যকর করার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেও তখন পর্যন্ত বিচারপতিদের স্বাক্ষরিত আপিল বিভাগের রায়ের সংক্ষিপ্ত অথবা পূর্ণাঙ্গ কোনো কপি কারা কর্তৃপক্ষ হাতে পায়নি। হাতে পায়নি মৃত্যু পরোয়ানাও।
অপরদিকে জেলকোড মানার একটি বিষয় রয়েই গেছে। কারা কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন ছিলো, যদি জেলকোড না-ই মানা হয় তাহলে কামারুজ্জামান এতোদিন যাবত কারাগারে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন তার সবই ছিলো কারাবিধি অনুযায়ী। কিন্তু রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে জেলকোড অনুসরণ করা না হলে ভবিষ্যতে আইনি প্রশ্ন দেখা দিলে এর দায় কে নেবে? কারণ, জেলকোড মানা না হলে কামারুজ্জামানকে জেলের বাইরে বিশেষ কোনো জায়গায় রাখতে হবে। ফাঁসি দিলেও দিতে হবে কারাগারের বাইরে।
প্রচলিত আইনে ফৌজদারি কার্যবিধি ও জেলকোডের বিধান অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জেলকোডের বিধান অনুযায়ী মৃত্যুদ-ের রায়ের কপি পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার জন্য আসামিকে সাত দিনের সময় দেয়া হয়। এই সাতদিন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি যদি ফাঁসি কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ বা দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস না করেন তাহলে কারা কর্তৃপক্ষকে ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়।
কারাবিধি অনুসারে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি বা সার সংক্ষেপ আপিল বিভাগ থেকে রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে যাবে। এরপর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। পরোয়ানার কপি কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবে। এরপর ফাঁসি কার্যকরের সম্ভাব্য তারিখ ও সময় উল্লেখ করে কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে একটি আবেদন পাঠাবে। আবেদনটি হবে রাষ্ট্রপতি ও সরকার বরাবর। এর এক সপ্তাহের মধ্যে আবেদনের কোনো জবাব না পেলে কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এরপর সরকার ইচ্ছাধীন সময়ে রায় কার্যকরের সময় ঘোষণা করবে।
এসব কারণে কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের সময় নিয়ে যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে তা এখন পর্যন্ত পরিস্কার হয়নি। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আপিল বিভাগ থেকে বিচারপতিদের স্বাক্ষরিত রায়ের কপি প্রকাশের খবর জানা যায়নি।
আপিল বিভাগ সোমবার কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশের প্রশ্নে বিভক্ত রায় দিয়েছে। বিভক্ত রায় হওয়ার কারণে তিন বিচারপতির রায়ের পর ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারপতি তার সংক্ষিপ্ত অথবা পূর্ণাঙ্গ রায় লিখবেন। তারপর দু’টি রায় একত্রে প্রকাশিত হবে। বিধি অনুযায়ী, রায়ের কপিতে বেঞ্চের সকল বিচারপতির স্বাক্ষর ছাড়া কোনো আদেশ কার্যকর হয়না। এছাড়া রাষ্ট্রপতিও বৃহস্পতিবার রাতে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন।