২০১০ সালের ১৩ জুন। গণহত্যার মামলায় জামিন নিতে এক সাথে হাইকোর্টে এসেছিলেন কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা। দুপুরে কামারুজ্জামান, বিকালে মোল্লা গ্রেপ্তার হন। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মোল্লার ফাঁসি হয় গত ১২ ডিসেম্বর। ১১ মাস পরে ফাঁসি হতে যাচ্ছে কামারুজ্জামানেরও।
পরিণতি একই হতে চললেও জীবনে শেষ সময়ে দুই রকমের সুযোগ পাচ্ছেন মোল্লা ও কামারুজ্জামান। সম্ভবত কামারুজ্জামান কম সুযোগ পাচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণার পর মোল্লার ফাঁসি হলেও সংক্ষিপ্ত রায়েই ফাঁসি হচ্ছে কামারুজ্জামানের।
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পেরে “ভি” চিহ্ন দেখিয়ে প্রিজন ভ্যানে চড়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান তিনি।
এ রায়ে বিক্ষুব্ধরা শাহবাগে আন্দোলন করলে ভূতাপেক্ষিক কার্যকারিতা দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন (১৯৭৩) সংশোধন করা হয়। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পান।
এ আপিলের রায় ঘোষণা করা হয় গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। চূড়ান্ত রায়ে যাবজ্জীবন বর্ধিত হয়ে চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পান মোল্লা। রায়ের পর পেরিয়ে যায় প্রায় আড়াই মাস। ৫ ডিসেম্বর ৭৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি এর তিন দিন পর ৮ ডিসেম্বর দুপুরে পৌঁছায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ওই দিনই মোল্লার মৃত্যু পরোয়না জারি করা হয়। বিকাল ৪টার দিকে লাল কাপড়ে মোড়ানো পরোয়ানার কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন ট্রাইব্যুনালে ডেপুটি রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী।
মৃত্যু পরোয়না পাওয়ার পরই মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৮ নম্বর কনডেম সেলে গিয়ে মোল্লাকে মৃত্যু পরোয়না পড়ে শোনানো হয়।
এ সময় তাকে সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগের কথা জানালে তিনি তার আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করে পরবর্তীতে জানানোর কথা বলেন।
পর দিন ৯ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকরের জন্য বাছাইকৃত জল্লাদদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই দিনগত রাতে ফাঁসির মঞ্চে জ্বালানো হয় বিশেষ আলো। যে দড়িতে মোল্লাক ঝোলানো হবে সে দড়িতে তার সমান ওজনের ইটসহ বস্তা বেঁধে মহড়া দেওয়া হয়।
১০ ডিসেম্বর সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার ফরমান আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, “যেদিন ওয়ারেন্ট পেয়েছি, সেদিন থেকে সাত দিন কার্যকর হবে। ৮ ডিসেম্বর থেকে কাউন্ট ডাউন, সাত দিন।”
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার বিষয়ে মোল্লার কাছে জানতে চাওয়ার ব্যাপারে ফরমান আলী বলেছিলেন, “কাদের মোল্লা এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মতামত জানাননি।”
পরে ওইদিন সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, মোল্লা প্রাণভিক্ষা চাইতে অস্বীকৃতি চাইতে অস্বীকার করায় রাত ১২টার পর যেকোনো সময় তার ফাঁসি কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাত ৮টার মধ্যে তার পরিবারের সদস্যদের কারাগারে আসতে বলা হয়েছিল। তারা দেখাও করেছিলেন।
তবে চেম্বার জজের কাছে আপিল রায়ের রিভিউ ও ফাঁসি কার্যকরে স্থগিতের আবেদন করলে ওই রাতে আর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। ১২ ডিসেম্বর শুনানি শেষে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ দুটি আবেদন খারিজ করে দিলে ওই দিন রাত ১০টায় মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।
তবে গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার পর কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে মোল্লার মত প্রক্রিয়া অনুসরন করা হচ্ছে না। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই আপিলের সংক্ষিপ্ত রায়ের ভিত্তিতেই তার ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগে নেয়া হয়েছে।
গত সোমবার আপিলের রায় ঘোষণার দিনই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের ফাঁসির মহড়া সম্পন্ন করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। বুধবার সকালে পরিবারের নয় সদস্য কারাগারে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
যদিও তার বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী দাবি করেছেন নিয়মিত সাক্ষাতের অংশ হিসেবেই তারা সাক্ষাৎ করেছেন। তবে তারা জেলখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফাঁসিকে কেন্দ্রে করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বেশি কিছু তৎপরতা দেখা গেছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দুপুর ১২টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত আইজি প্রিজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
এরপর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন আনিসুল হক।
পরে সন্ধ্যায় গুলশানের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী জানান, সংক্ষিপ্ত রায়ের লিখিত কপি থেকেই রায় কার্যকর করা যাবে। রায়ের সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাইলে যে কোনো দিন রায় কার্যকর করা হবে।
আইজি প্রিজনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জেল কোড ও আইন মেনে কারা কর্তৃপক্ষকে রায় কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
রিভিউ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, “এর আগেও দেখেছি রিভিউর আবেদন বাতিল করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের একটি নজির আছে রিভিউ খারিজ হওয়ার।”
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মোল্লার চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সরকারের বাইরে ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে তখন তিনি বলেছিলেন, “সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল পুনর্বিবেচনার আবেদন করার অধিকার দণ্ডিতের আছে। এ অধিকার যদি দেয়া হয়, তাহলে রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কোন দিন প্রশ্ন উঠবে না।”
এখন মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার নজির দেখিয়ে কামারুজ্জামানের এই অধিকার না থাকার কথা বললেন আইনমন্ত্রী। কিন্তু রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১১ মাসেও প্রকাশিত হয়নি। কাজেই মোল্লা যা পাননি তা কামারুজ্জামানের না পাওয়া নিয়ে বিতর্ক থেকে গেল।
তবে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে এটি পষ্ট হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে সাত দিনের মধ্যে প্রাণভিক্ষার সুযোগটি দিতে সরকারের সম্মতি আছে।
অবশ্য এক্ষেত্রেও মোল্লার চেয়ে কম সুযোগে পাচ্ছেন কামারুজ্জামান। ট্রাইব্যুনাল থেকে মোল্লার মৃত্যু পরোয়না কারাগারে পৌছানোর পর থেকে সাত দিনের সময় গণনা করা হয়েছিল। কিন্তু কামারুজ্জামানের সাত দিন গণনা শুরু হয়েছে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার দিন থেকেই।
গত বছর মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের নিয়ম প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেছিলেন, “কারাবিধি অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবে। তবে যখন তারা জানবেন, কাদের মোল্লার আপিল খারিজ হয়ে গেছে, সে মুহূর্ত থেকে ফাঁসি দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করবে। প্রক্রিয়া শুরুর ২১ দিন পর এবং ২৮ দিনের আগে ফাঁসি কার্যকর করার নিয়ম।”
কারাবিধি অনুসারে এই ফাঁসির আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে আসামীর প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি। এই সাত দিন গণনা করা হয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে মৃত্যু পরোয়ানা পৌঁছানোর পর থেকে।
মোল্লার ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাতদিন গণনা করার বিষয়টি ওই সময়েই কারাগারের সুপার ফরমান আলী নিশ্চিত করে বলেছিলেন।
সব শেষ খবরে জানা গেছে, বুধবার পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বা ট্রাইব্যুনাল থেকে কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়না কারাগারে পৌঁছায়নি। কিন্তু আইনমন্ত্রী দাবি করছেন, আপিল বিভাগের সোমবার রায় ঘোষণার দিন থেকেই সাত দিন গণনা শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে আগামী রবিবার সাত দিন শেষ হলে যেকোনো সময় রায় কার্যকর করা হবে বলে জানান তিনি।
কারাবিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে জেল সুপার তা স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে পাঠাবেন। সাথে আলাদা চিঠিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সম্ভাব্য তারিখ এবং আসামির দণ্ডের বিষয়ও থাকবে।
বিধি অনুযায়ী এ আবেদন সাত থেকে ১৫ দিনের মধ্যে অনুমোদন বা নাকচ না করলে ধরে নেওয়া হবে রাষ্ট্রপতি প্রাণ ভিক্ষা দেননি। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকর করবেন।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের বরাতে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছে, “রাষ্ট্রপতি সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে বেইজিংয়ের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন।”
আগামী ৯-১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার (অ্যাপেক) সিইও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বেইজিং যাবেন রাষ্ট্রপতি। বেইজিংয়ে অ্যাপেক সিইও শীর্ষ সম্মেলন-২০১৪ চলবে।
রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে ফেরার পথে চিকিৎসার জন্য ১১ নভেম্বর চীন থেকে সিঙ্গাপুর যাবেন।