আইনি ফাঁক-ফোঁকরের কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। দেশের প্রায় সকল ছোট-বড় খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মান বহির্ভূত নিম্নমানের খাদ্যপণ্য তৈরি করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এ নিয়ে উৎপাদক, বিক্রেতা, জনসাধারণ, তদারকি সংস্থা, সরকার, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ৪২ বছরেও দেশে তৈরি হয়নি খাদ্যমানের নির্দিষ্ট একক। তাই খাত হিসেবে চিন্তা করলে খাদ্য খাতই দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বলে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর হোটেল অবকাশে ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
তিনি অভিযোগ করেন, আইনি ফাঁক-ফোঁকরের কারণেই বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা উচ্চ আদালতে গিয়ে আটকে যায়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খাদ্যমান উন্নয়নে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পরিস্থিতির উন্নতির চেয়ে অবনতি হয়েছে বেশি।
তিনি আরও বলেন, সরকার আইন করে দেশের প্রতি জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা রোধ করেছে। এটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার। খাদ্য আমদানিকারক ও উৎপাদকদের সবাই প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এর সঙ্গে আছে প্রসাশনিক জটিলতা, জনবলের অভাব ও অর্থ সংকট।
অনুষ্ঠানে, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ দ্রুত বলবৎ করাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনের কার্যকর প্রয়োগের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে টিআইবি।
‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবি পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়। এতে মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহনুর রহমান।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিকুল হাসান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও একটি সার্বিক নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগের অভাব রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ পাশ হলেও গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আজও তা কার্যকর করা হয়নি।
প্রতিবেদনে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক আইনি কাঠামোতে সীমাবদ্ধতা ও প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জ এর যে তথ্য উঠে এসেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ বলবৎ না করা; ভোক্তার সরাসরি মামলা করার বিধান না থাকা ও ভোক্তার অভিযোগ নিরসনে প্রক্রিয়াগত জটিলতা এবং ভোক্তা বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কর্তৃক নমুনা পরীক্ষার ব্যয়ভার বহনের বাধ্যবাধকতা।
খাদ্য তদারকি ও পরিবীক্ষণের ক্ষেত্রে জনবলের স্বল্পতা একটি অন্যতম সীমাবদ্ধতা হিসেবে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩১৯টি পৌরসভা ও ১১টি সিটি কর্পোরেশনে অর্গানোগ্রামে ৩৭০টি স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৭৮ জন।
এছাড়া এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি; চুক্তিভিত্তিক আইনজীবী না থাকা ও মামলা পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ; সংশ্লিষ্টদের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়, সহযোগিতা ও যোগাযোগের অভাব; ফরমালিন আমদানিতে তদারকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের অভাব; খাদ্যের নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা; পরীক্ষাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাব; এবং খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
গবেষণায় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে বলা হয়- স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা খাদ্যপ্রস্তুতকারী রেস্তোরাঁ বা বেকারি ও খুচরা বিক্রেতা পরিদর্শনে ঘুষ গ্রহণ; বিএসটিআই’র ফিল্ড অফিসার খাদ্য কারখানা পরিদর্শনে খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহে ঘুষের বিনিময়ে শৈথিল্য প্রদর্শন (ক্ষেত্রভেদে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও ফিল্ড অফিসারগণ ৫০০-১০০০০ টাকা ঘুষ নিয়ে থাকেন); মাসিক ভিত্তিতে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর কর্তৃক বড় দোকানদার, রেস্তোরাঁ ও বেকারির মালিকের সাথে সমঝোতামূলক দুর্নীতি; স্যানিটারি ইন্সপেক্টর কর্তৃক আইনের ভয় দেখিয়ে মূল্য পরিশোধ না করে নমুনা সংগ্রহ এবং ব্যক্তিগত ভোগে ব্যবহার; ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কিছুসংখ্যক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর কর্তৃক পরিদর্শন কার্যক্রমে নিজ উদ্যোগে সোর্স নিয়োগ এবং সোর্সদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের খরচও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায়; জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে মাঠ পর্যায়ের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের যোগসাজস ও নমুনা পরীক্ষা না করে ঘুষ ও উপঢৌকনের বিনিময়ে সনদ প্রদান; এবং আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষায় ঘুষের বিনিময়ে পরীক্ষাগার হতে সনদ গ্রহণ ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, তদারকিতে মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধুমাত্র আইনিভাবে তাদের কর্ম এলাকা নির্ধারণ, মাঠ পর্যায় হতে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষাগারে প্রেরণের ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয় থাকলেও সার্বিকভাবে বাজার মনিটরিং ও তদারকি কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা ও যোগাযোগের অভাব রয়েছে।
এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে একে অপরের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা লক্ষ্যণীয়। এছাড়া মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় জেলা প্রশাসন ও প্রসিকিউটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। অনেক সময় জেলা প্রশাসন হতে নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রসিকিউশন কর্মকর্তারা ফিল্ডে হাজির হলেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যস্ততা বা অনুপস্থিতির কারণে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয় না এবং এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন অফিস হতে অনেক সময় তাদের সময়মত অবহিত করা হয় না।
সংবাদ সম্মেলনে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কার্যকর আইনি কাঠামো বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক ও তদারকি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৬ দফা সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ সংশোধন করে তা দ্রুত বলবৎ করা; ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিধান চালু এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা প্রদান বাধ্যতামূলক করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা; প্রতিটি জেলা ও মহানগরে খাদ্য আদালত গঠন করা; স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএসটিআই ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও ফিল্ড অফিসার নিয়োগ প্রদান এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশি সহায়তা প্রদানসহ প্রশাসনের সাথে সমন্বয় বিধান নিশ্চিত করা ইত্যাদি।