বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বাড়ছে। সামপ্রতিক কিছু ঘটনায় জামায়াত নেতারা মনে করছেন বিএনপির সঙ্গে তাদের মিত্রতা ভেঙে যেতে পারে। তবে নিজ থেকে জামায়াত জোট ভাঙবে না। জামায়াত নেতারা মনে করছেন রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন কিংবা সুবিধা লাভের জন্য বিএনপি যে কোন উদ্যোগ নেয়ার এখতিয়ার রাখে। সে ক্ষেত্রে জামায়াতকে বাদ দিয়ে চলতে চাইলে চলবে। বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বকে ইতিমধ্যে এমন ইঙ্গিত দেয়াও হয়েছে। উভয় দল স্থায়ী কোন চুক্তিতে আবদ্ধ নয় বলেও মনে করেন জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা। বিএনপি-জামায়াতের মিত্রতা নিয়ে সামপ্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে দলটির সর্বস্তরে এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ‘জামায়াতের সঙ্গে জোট কৌশলগত’ ১০ই জানুয়ারি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের পর নড়েচড়ে বসে জামায়াত। তারা মনে করছেন বিএনপি যে কোন সময় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে পারে। জামায়াত নেতারা বলেন, সত্যিকার অর্থে বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক কোন আদর্শিক নয়। রাজনৈতিক। এ ধরনের রাজনৈতিক সম্পর্ক নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ছিল। তবে পরে আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আচরণসহ নানা কারণে সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। নতুন ঐক্য গড়ে ওঠে বিএনপি’র সঙ্গে। শিবিরের রাজনীতি ছেড়ে জামায়াতে যোগ দেয়া এক নেতা বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এ সরকারের পতন। তবে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জামায়াত-শিবির সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি আছে কি নেই তা না দেখে নিজের প্রয়োজনে যে কোন কৌশলে সক্রিয় থাকবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সামপ্রতি সৃষ্ট দূরত্ব ও মান অভিমানের প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে রাজনীতির মাঠে। বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি’র মধ্যে দূরত্ব বাড়ার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় ২৯শে ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। ওই দিন রাজধানীর টিকাটুলি ও মালিবাগে মিছিল করে শিবির। মালিবাগে শিবিরের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শিবির নেতা মনসুর নিহত হন। ১৮ দল ঘোষিত এই কর্মসূচিকে পরে আরও একদিন বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু শরিক দলের তৎপরতা না দেখে শেষ দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জামায়াত-শিবির। ১২ই জানুয়ারি নতুন সরকারের যাত্রা শুরুর পর শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানামুখী কাজে মনোযোগী হয় তারা। বিষয়টি স্বীকার করে দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে আত্মরক্ষা এবং সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত হওয়া ছাড়া জামায়াতের সামনে কোন পথ খোলা নেই। সংশ্লিষ্টরা জানায়, মার্চ ফর ডেমোক্রেসি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে হঠাৎ থমকে যায় জামায়াত-শিবির। চলমান আন্দোলনে দেশব্যাপী জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এই ক্ষয়ক্ষতি রোধে জরুরি বার্তা পাঠান দায়িত্বশীলদের কাছে। নির্দেশ দেন কৌশলী কর্মসূচি দিতে- যাতে নেতাকর্মীদের প্রাণহানির সংখ্যা আর না বাড়ে। সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতিও যেন আর না হয়। ইতিমধ্যে এই বার্তা পৌঁছে যায় দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে। সূত্র মতে, জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণা এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়ে জামায়াত। এই দুই ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় প্রায় দু’শ’ শিবিরকর্মীর প্রাণহানি ঘটে। তবে এসব সহিংসতার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুসহ চলমান আন্দোলনও যুক্ত ছিল। তবু নেতাকর্মীদের লাশের সারি আর বাড়তে দিতে চান না জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। তারা আইনজীবী এবং কারাগারে সাক্ষাতে যাওয়া নিকটজনের মাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের মামলায় আটক নেতাদের যা হওয়ার হোক। এ ক্ষেত্রে কেবল আইনি লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। সংঘাত-সহিংসতা নয়। নয় আর কোন প্রাণহানি। সংশ্লিষ্টদের মতে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের এই বার্তার দ্রুত প্রতিফলন দেখা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি পালনের প্রথম দিন ২৯শে ডিসেম্বর রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের গুলিতে এক শিবির নেতা নিহত হন। ওই ঘটনার পর থেকে কৌশলী ভূমিকায় মাঠে থাকছে জামায়াত-শিবির। তারা যতটা সম্ভব ঝুঁকিমুক্ত থেকে বিক্ষিপ্ত মিছিল করছে। তবে যৌথ বাহিনীর অভিযানের কারণে হতাহতের ঘটনা এড়াতে পারছে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি’র সঙ্গে শুরু হয় টানাপড়েন, মান অভিমান। বিষয়টি স্বীকার করে শিবিরের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, চলমান আন্দোলনে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি। সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারও করেছি। কিন্তু সহযোগী ছাত্র সংগঠনের জোরালো ভূমিকা না থাকায় তেমন সুফল পাওয়া যায়নি। তবু আমাদের নেতাকর্মীরা হতোদ্যম নয়। তারা শেষ পর্যন্ত অর্পিত দায়িত্বপালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শিবিরের এই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কিছু পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে না। তাদের সংগ্রাম ত্যাগ আল্লাহর রাস্তায়। এদিকে চলমান প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে এ মুহূর্তে রক্ষণাত্মক কৌশলে মাঠে থাকতে চায় জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে এমন কৌশল নিচ্ছে বিপর্যস্ত দলটি। কারাবন্দি শীর্ষ নেতারাও এমনটি চান বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানায়। যুদ্ধাপরাধ সন্ত্রাসবাদসহ নানা ইস্যুতে একেবারে খাদের কিনারে ১৮ দলের শরিক দলটি। যে কোন সময় রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে এ দলের কার্যক্রম। সামপ্রতিক আন্দোলনে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি তারা। এ অবস্থায় আত্মরক্ষামূলক কর্মসূচির দিকে ঝুঁকছে জামায়াত।