রাজশাহীর আনোয়ারুল ইসলাম টুটুল একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা ছিলেন ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১২ লাখ টাকাই ছিল ঋণের। একে তো ঋণের বোঝা, তার ওপর পরিবারে খাবারের কষ্ট। নিজেকে নিরুপায় ভেবে বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ। গত মঙ্গলবার (১ জুন) তার আত্মহত্যার খবর পায় পুলিশ। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখে গেছেন কষ্টের কথা। ঘরে বসে আয়ের স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে কথিত একটি প্রতিষ্ঠান রেক্স আইটিতে বিনিয়োগ করে হয়েছেন নিঃস্ব।
টুটুলের স্ত্রী নাসরিন আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টুটুল দুই বছর বয়স থেকে ফুসফুসের জটিলটায় ভুগছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তা তীব্র আকার ধারণ করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নাম সিওপিডি বা দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি। শ্বাসতন্ত্রের একটি গুরুতর রোগ। এ রোগে ক্রনিক ব্রংকাইটিস (দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসনালীর প্রদাহ) এবং এমফাইসিমা বা বায়ুস্ফীতিজনিত সমস্যার কারণে ফুসফুসের স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে বিঘ্ন হয়। আগে রোগটিকে ক্রনিক ব্রংকাইটিস বলা হতো। সিওপিডিতে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় এবং এই রোগ ক্রমে গুরুতর হতে থাকে। এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও চিকিৎসার মাধ্যমে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে তীব্রতা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
টুটুলের স্ত্রীর ভাষ্য- তিনি আগে থেকেই জানতেন বেশিদিন বাঁচবেন না। চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন যদি ভালো পরিবেশে বাস করেন তবে বড়জোর ২-৪ বছর বেশি বাঁচতে পারেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকার অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
তার স্ত্রী আরও জানান, রেক্স আইটিতে টুটুল এসএমই ঋণ করে ১২ লাখ টাকা এবং নিজ সঞ্চয়ের ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। সঞ্চয়ের ৫ লাখ টাকা দিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি (টুটুলের স্ত্রী) অবগত ছিলেন না। রেক্স আইটির সত্ত্বাধিকারী পলাশ তাকে প্রতি লাখে কমিশন দিতেন। এখান থেকে শুধু ২৪ হাজার টাকার মতো ফেরত পেয়েছেন। রেক্স আইটি থেকে টাকা উদ্ধার করতে না পেরে টুটুল নিজেই ঘরে বসে সিপিএ মার্কেটিংয়ের কাজ করতেন।
২০০ কোটি টাকা হাতিয়েছে রেক্স আইটি
টুটুল যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তার নাম রেক্স আইটি ইন্সটিটিউট। বেকার যুবকদের কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটিতে আউটসোর্সিং, গ্রাফিক ডিজাইন, এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন), ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বিনিময়ে নেওয়া হতো অর্থ।
পেইড মার্কেটিংয়ের প্রচারণা বেছে নিয়ে বেকার প্রশিক্ষণার্থীদের সেই প্রতিষ্ঠান অফার দিতো, ‘বিনিয়োগ করলেই ৫০ থেকে শতভাগ রিটার্ন’। ২০১৯ সালে সিআইডি’র হাতে ধরা পড়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক আব্দুস সালাম পলাশ। যার কাছে ১৭ লাখ টাকা পাওনা থাকার কথা উল্লেখ করে গেছেন আত্মহত্যাকারী টুটুল। পলাশের নামে ধানমণ্ডি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়েছে।
রেক্স আইটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমে ফ্রি মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে আগ্রহীদের নিয়োগ করা হতো। পরে তাদের পেইড মার্কেটিংয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। তাদের বলা হতো পেইড মার্কেটিং করতে এবং এর জন্য পেপাল অথবা ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েসহ ক্রেডিট কার্ড থাকতে হবে।
আর বাংলাদেশে যেহেতু পেপালের কার্যক্রম নেই তাই তারা এখনই সরাসরি মার্কেটিং করতে পারবে না। প্রথম দিকের বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি লাভ দেখানো হতো ও ক্যাশে তাদের পেমেন্ট দেওয়া হতো। ফলে তারা আরও বেশি টাকা নিয়ে এসে বিনিয়োগ করতো। পরে টাকার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তাদের আংশিক পেমেন্ট দেওয়া হতো আর বলা হতো বাকি টাকা পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়েছে।
সিপিএ মার্কেটিং
সিপিএ মার্কেটিং মূলত একটি বিজ্ঞাপনী পন্থা। তবে এর মাধ্যমে সরাসরি কোনও পণ্য বিক্রি করতে হয় না। সিপিএ হচ্ছে- কস্ট পার অ্যাকশন। অর্থাৎ প্রতিটি অ্যাকশনের বিনিময়ে কমিশন। এই অ্যাকশন হতে পারে একটি ক্লিক, কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ইমেইল আইডি দিয়ে সাবস্ক্রাইব করার কাজ।
সিপিএ মার্কেটিংয়ে বিভিন্ন ধরনের অফার থাকে। কোনও ভিজিটর যদি অফারটি নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন কিংবা ভিজিট, ডাউনলোড, ইমেইল আইডি দেওয়া, সাবস্ক্রাইব করা, নির্দিষ্ট কোনও গেইম খেলা, কোনও অফার কেনেন, তবে প্রতিটি অ্যাকশনের জন্য তাকে পেমেন্ট করা হয়। যা প্রকৃত অর্থে কাজের বিনিময় কমিশন। আর এমন কাজ করতে যখন টাকা বিনিয়োগ করতে হয় তখন সেটাকে ‘পেইড মার্কেটিং’ বলা হয়।
রেক্স আইটির ফেসবুকে পেজে গিয়ে তাদের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। সেখানে উল্লেখ করা আছে- ‘এখন আরও শক্তিশালী সাপোর্ট টিম নিয়ে শুরু হয়েছে রেক্স আইটি ইনস্টিটিউট। প্রফেশনাল সিপিএ মার্কেটিং কোর্স ফি মাত্র ১০ হাজার টাকা। কিন্তু করোনা মহামারি বিবেচনা করে এবং হ্যাপি নিউ ইয়ার উপলক্ষে ২০ শতাংশ ডিসকাউন্ট-এ মাত্র ৮ হাজার টাকা। কোর্স চলাকালীন থাকছে শতভাগ ইনকাম-এর নিশ্চয়তা।’
গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত তাদের এ ক্যাম্পেইন চালালেও একইদিনে একটি পোস্টে জানানো হয়েছে – মহামান্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চলমান মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রেক্স আইটি ইন্সটিটিউট-এর সকল ক্যাম্পাসের সকল প্রকার অফিসিয়াল এবং অনলাইন কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।
বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে অনেকেই বেছে নেন ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার। দেশে এরকম কাজে নিয়োজিত কতজন আছে তার সঠিক হিসাব নেই কারও কাছে। তবে পেইড মার্কেটিংয়ের কাজকে ফ্রিল্যান্সিং বলতে নারাজ ফ্রিল্যান্সাররা।
ফ্রিল্যান্সিং কী
ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে কোনও কোম্পানিতে সরাসরি চাকরির বদলে নিজ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে চুক্তিভিত্তিক কাজ করা। নির্ধারিত সময়ে কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। তবে সব কাজই আইটি সম্পর্কিত নয়।
বিভিন্ন কোম্পানির একাউন্টিংয়ের কাজও ফ্রিল্যান্সার হিসেবে করার সুযোগ আছে। তাছাড়া ভাষান্তরের কাজ, গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েবসাইট তৈরি, নিবন্ধ লেখা, ভিডিও সম্পাদনার কাজও ফ্রিল্যান্সিং হিসেবে করার সুযোগ আছে। কাজগুলো ঘণ্টা, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক হিসেবে করা যায়। এক এক কাজের পারিশ্রমিক এক এক রকম। যত কাজ তত আয়। এতে কোনও বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না।
দীর্ঘ সাত বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করছেন গোলাম রাব্বি। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে অনেক ধরনের কাজ আছে বলে জানান তিনি। আপওয়ার্কের মতো বেশ কয়েকটি ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইটে কাজ পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। আরও বললেন, ‘অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ডাটা এন্ট্রির কাজকে বলা হয় একদম প্রাথমিক লেভেলের কাজ। এই কাজ পেতে প্রথমে একাউন্ট খুলতে হয় , এরপর পেমেন্ট গেটওয়ে ঠিক করতে হয়। তারপর কাজ খুঁজতে হয়।’
রাব্বির মতে, আপওয়ার্কে গড়পড়তায় মিনিটে দুটি করে কাজের পোস্ট করেন বায়াররা। সেখান থেকে কাজ পেতে বিড করতে হয়। বায়ার যার সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হবেন তাকেই কাজ দেবেন। এক্ষেত্রে বায়ার তথা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে পারিশ্রমিক আগেই নিজেদের একাউন্টে জমা নেয় মার্কেটপ্লেসগুলো। কাজ শেষ হওয়ার পর সেই টাকা ফ্রিল্যান্সারের অ্যাকাউন্টে চলে আসে। পেমেন্ট নিরাপদ রাখতে মার্কেটপ্লেসগুলো গড়ে ২০ শতাংশ হারে কমিশন নেয়। আপওয়ার্ক সাইটটিতে ৫০০ ডলারের ওপর পেমেন্ট হওয়ার পর কমিশনের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
রাব্বি আরও জানান, পেওনেয়ারের মাধ্যমে পেমেন্ট এনে এখানে ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে সেই টাকা তোলা যায়। অন্য ব্যাংক থেকেও তোলা যায়। তবে তাতে সময় বেশি লাগে।
দেশের ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটির অন্যতম সদস্য সাইদুর মামুন খান। তিনি নিজে আগে ফ্রিল্যান্সার ছিলেন। পরে যোগ দেন বিশ্বখ্যাত মার্কেটপ্লেস (সাবেক) ওডেস্কের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে। ওডেস্ক নাম বদলে আপওয়ার্ক হলে তিনি তাতে বাংলদেশে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। সেখানে বর্তমানে মার্কেটিং ডেটা অপারেশনের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে কোন একটা ক্লায়েন্টের জন্য অথবা কোনও একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে দেওয়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কয়েক মাসের জন্য ম্যানেজ করে দেওয়া কিংবা কারও জন্য আর্টিকেল লিখে দেওয়া বা লোগো ডিজাইন করে দেওয়া এসব। যখন একটি সেবা আরেক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় করা হচ্ছে; সেটাই হলো ফ্রিল্যান্সিং।
ফ্রি ল্যান্সিংয়ের কাজ একদম প্রোগ্রামিং লেভেলের কোর আইটি সম্পর্কিত নাও হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হয়তো কোনও ক্লায়েন্টের অনেকগুলো পিডিএফ ফাইল এক্সেল শিটে করে দিতে হবে। এখন এখানে আইটি সাপোর্ট প্রয়োজন বলতে কম্পিউটার আর ইন্টারনেট লাগবে। এটাকে আইটি এনেবেলড সার্ভিস বলা চলে। নন আইটি বলতে আছে –একাউন্টিং। আমাদের দেশে প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে যারা ফ্রিল্যান্স একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করে। ক্লায়েন্টের হয়তো অনেক হিসাব এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। কুইক বুকের মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করে তারা একটা লেজার সাজিয়ে দিচ্ছে। যাতে তাদের বার্ষিক হিসাব ঠিকমতো করতে পারে। একটি একটি স্কিল ধরে ৩-৪ হাজার ধরনের স্কিলের কাজ করা সম্ভব এই সেক্টরে।
ফ্রিল্যান্সিং-এ ব্যক্তিগত বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিনিয়োগ বলতে এখানে এমন হতে পারে যে- দেখা গেলো একজন ফ্রিল্যান্সার একা কাজ করে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, তখন তিনি একটা অফিস তৈরি করে আরও কয়েকটি কম্পিউটার ও আরও কয়েকজনকে নিয়োগ দিলেন। নিজের কাজ ভাগ করে দিলেন। সেটাই হলো বিনিয়োগ। কিন্তু আরেকটি কোম্পানিকে টাকা দেওয়া এবং সেটা যদি এমএলএম বিজনেস ঘরানার হয়, ফেইক ইমেইল এড্রেস কিনে বিভিন্ন ফোরামে কেনাবেচা করা হয়, সেটা ফ্রিল্যান্সিং নয়। সেটা অনেকটা ‘স্ক্যাম’ তথা ভাওতাবাজি হয়ে যায়।”