ব্রেকিং নিউজ
Home / প্রচ্ছদ / গণতন্ত্রের তিন গোরখোদক

গণতন্ত্রের তিন গোরখোদক

61502_1-1‘আমি জাতির আব্বার নির্লজ্জ কন্যা, আমার মাঝে বহে স্বেচ্ছাচারিতার বন্যা। এ দেশ ধ্বংস হোক, আমার বেহায়াপনার জয় হোক। সবাই বলুক প্রহসনের নির্বাচন, তাতে কি হয়েছে?’ আমার দেশ-এর অনলাইন পাঠক প্রবীর রায় গতকাল পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ পড়ে কমেন্ট অপশনে এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। শহীদুল ইসলাম নামক এক পাঠক মশকরা করেন এভাবে—‘আমার চোখ একেবারেই গেছে। সারাদিন দেখলাম ভোটারশূন্য কেন্দ্র আর সন্ধ্যায় দেখি লাখ লাখ ভোট’। পাঠক রকীবুদ্দিনের মন্তব্য, ‘মুখরক্ষা করতে গিয়ে গণতন্ত্র দাফন করা হয়েছে’। সরকার মারুফ নামের এক পাঠক লিখেছেন—‘এই সরকার নির্লজ্জতার সব সীমা ছাড়িয়ে মহাস্বৈরাচারীতে পরিণত হয়েছে’। মইনুল ইসলামের আক্ষেপ—‘এই লজ্জা রাখি কোথায়?’। হাসানুজ্জামানের প্রশ্ন ‘সেই সব বুদ্ধিজীবীরা কোথায়, যারা এই নির্বাচনকে সমর্থন করে দেশের এতবড় ক্ষতি করল?’ রাসেল নামের এক পাঠকের মন্তব্য—‘ভোটারবিহীন ভোট দেখে অনেক মজা পাইলাম। শতাব্দীর সেরা জোকস এই নির্বাচন’। মেহেদী হাসানের আক্ষেপ—‘৫ বছর পর ভোট দিব বলে আশায় থাকি। সেটিও আওয়ামী লীগ কেড়ে নিল, ভোট দিল গৌরাঙ্গ বৈরাগী’ । বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমের কমেন্ট অপশনে এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে শাসকদের ‘ধবল ধোলাই’ চলছে এভাবেই।
রোববার অনুষ্ঠিত ভোটারবিহীন লজ্জাজনক নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষ ক্ষোভে-দুঃখে গুমরে মরছে। দেশি-বিদেশি নানা মহলের এবং দেশের সিংহভাগ জনগণের প্রত্যাশার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলদর্পী ও ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠী যেনতেনভাবে ভোটারবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করেছে। বিভিন্ন মহল থেকে এ নির্বাচনের আগে বারবার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মুখে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যেমনি সম্ভব নয়, তেমনি এ ধরনের নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সরকার একে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন বলে যতই প্রচার করুক না কেন, ভোটারবিহীন এ নির্বাচন কোনোভাবে বৈধতা পাবে না তা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। রঙ্গ-তামাশার রকীব মার্কা নির্বাচনে বরং জনগণ সরকারের প্রতি ধিক্কার ও অনাস্থা জানিয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা বলছেন।
নির্বাচনের আগের দিন ৪ জানুয়ারি দেড় শতাধিক ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়া হয়েছে। ভোটের দিন ৫ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন স্থানের ভোটকেন্দ্রে ভোটের সরঞ্জাম ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ওপর আক্রমণ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচনী সহিংসতায় ২৫ জনের বেশি নিহত এবং অনেক আহত হয়েছে। ভোটের দিনের সহিংসতায় এতসংখ্যক প্রাণহানি বাংলাদেশে নতুন রেকর্ড। প্রতিবাদী জনতার প্রতিরোধের মুখে পাঁচ শতাধিক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণই সম্ভব হয়নি। নতুন রেকর্ড গড়ে অর্ধ শতাধিক কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। আরও সমানসংখ্যক কেন্দ্রে ভোট পড়েছে এক থেকে ৫টি। নির্বাচন বর্জনকারী জাতীয় পার্টি হয়ে ৩৩ আসন জিতে হয়ে গেছে প্রধান বিরোধী দল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেও নির্বাচিত হয়ে গেছে এরশাদসহ জাপা নেতারা।
গত শনিবার প্রকাশিত একটি ইংরেজি দৈনিকের জনমত জরিপ থেকে উঠে আসা ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এই ভোটারবিহীন, বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে। ভোট শেষে দেখা গেল প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পাতানো নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার একতরফা প্রহসনের নির্বাচন স্থগিত করার জন্য দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, বিশিষ্ট নাগরিক, পত্রিকার স্বনামধন্য সাংবাদিক ও সুশীলসমাজ সরকারের প্রতি আগেই আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশের বাইরে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, জাপানসহ অন্য আরও দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই নির্বাচন বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে আসছিল এবং সবার পরামর্শ ছিল বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তুলে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনের। কিন্তু সরকার একগুঁয়েমি প্রদর্শন করে সমঝোতার দিকে যায়নি। এই একগুঁয়েমির কারণে খেসারত দিতে হলো অনেক প্রাণ, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সর্বোপরি সমাহিত হলো গণতন্ত্র।
নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রকে যেভাবে নৃসংশভাবে হত্যা করা হলো তার দায় প্রধানত তিনজনের বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। বিশ্লেষণে দেখা যায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা, বহুল বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকীব উদ্দিন পরস্পর যোগসাজশে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছেন।
রোববার তামাশার এক নির্বাচনী নাটকের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে যে কবরে দাফন করা হয়েছে সে কবরটি খোঁড়া শুরু হয়েছে ২০১০ সালের ১১ মে। ওইদিন তত্কালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চের তরফ থেকে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। এই বাতিলের পক্ষে তিনজন বিচারক এবং বিপক্ষে তিনজন বিচারক অবস্থান নিয়েছিলেন। এই অবস্থায় সভাপতিত্বকারী প্রধান বিচারক খায়রুল হক তার কাস্টিং ভোট দিয়ে বাতিলের রায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করেন এবং এর ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে ওই সরকার কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করে সংবিধানের যে সংশোধনী জারি করা হয়েছিল তা বাতিল ঘোষণা করা হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল যে, সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন বেআইনি ঘোষিত ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বর্ণিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে। এক্ষেত্রে যে নীতিটার কথা বলা হচ্ছে সেটা হচ্ছে-্থঞযধঃ যিরপয ড়ঃযবিরংব রং হড়ঃ ষধভিঁষ, হবপবংংরঃু সধশবং ষধভিঁষ ধহফ ঃযধঃ ঃযব ংধভবঃু ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ঃযব ংঃধঃব রং ঃযব ংঁঢ়ত্বসব ষধ.্থি
কিন্তু সংক্ষিপ্ত রায় দেয়ার পর অবসরে গিয়ে দীর্ঘ ১৬ মাস বাসায় বসে যে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন তাতে সংক্ষিপ্ত রায়ের মূল বিষয়বস্তুই পাল্টে দেন। ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে খায়রুল হক সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীল-নকশা বাস্তবায়নের পথ সুগম করে দেন। আইন ভেঙে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিত্সার জন্য স্ত্রীর নামে দশ লাখ টাকা গ্রহণকারী বিচারপতি খায়রুল হক তার রায়ে বলেছেন, ১৯৯৬ সালের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আইন সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং মৌলিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেয়ার কারণে বিতর্কিত আইনটি অসাংবিধানিক, বেআইনি এবং অকার্যকর বলে গণ্য হয়েছে। রায়ে তিনি আরও বলেছেন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি সংসদের কর্তৃত্বাধীন। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া যেতে পারে এবং এ সময়টি ৪২ দিন হতে পারে। তার রায় অনুযায়ী নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নতুন মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বাভাবিক এবং সাধারণ কার্যাবলি সম্পাদন করবে। রায়ে উল্লেখ করা হয়, যদিও ১৯৯৬ সালের সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইনটি অসাংবিধানিক এবং বেআইনি তথাপিও পার্লামেন্ট তার বিশেষ ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তক্রমে দশম ও একাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আকার ও আকৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারবে। খায়রুল হকের এই রায়কে অজুহাত করেই মহাজোট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরি বিলোপ করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বিষয়টি পাকাপোক্ত করে।
২০১২ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাশ করার আগে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞদের মতামত নিলে প্রায় সবাই খায়রুল হকের রায়ের শেষাংশ অনুযায়ী অন্তত দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। সংশোধনী সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরাও একই মত দিয়েছিলেন। তখন কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন প্রকাশ্যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে দেয়ার বিরোধিতা করেন। কিন্তু ওই কমিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি বৈঠক করলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সবার মতামত উপেক্ষা করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করা হয়। বস্তুত ওই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সমাহিত করার কবর খোঁড়ার কাজটি বহুলাংশে সম্পন্ন হয়।
আর এ কাজটি পুরোপুরি সম্পন্ন করেন আওয়ামী লীগ সরকারের সেবাদাস নির্বাচন কমিশনের প্রধান রকীব উদ্দিন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে, সংসদ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। একই সঙ্গে মেয়াদ শেষে আগে সংসদ কোনো কারণে ভেঙে দেয়া হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যেও নির্বাচনের সুযোগ সংবিধানে রয়েছে। যেখানে নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের সেটাই করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান অনুসরণের কথা বলে যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন করা গণতন্ত্র হত্যার সামিল বলেই মত দিয়েছেন সংবিধা বিশেষজ্ঞরা।
সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ভাষায় ‘প্রত্যক্ষ’, অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ প্রতিদ্বনিন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। অর্থাত্ আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগ নেত্রীর ক্ষমতালিপ্সার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে দেশে একটি নজিরবিহীন কলঙ্কের নির্বাচন করেছে। আর এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও গণতন্ত্রকে কবরস্থ করার অন্যতম খলনায়কের ভূমিকা রেখেছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন অনুযায়ী সত্যিকার নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য। ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের নামের যে চুক্তি বাংলাদেশ ২০০০ সালে স্বাক্ষর করেছিল, তাতে প্রত্যেক নাগরিকের ‘ভোট প্রদান ও নির্ধারিত সময়ের পর সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার’ অধিকার প্রদানে অঙ্গীকার করা হয়েছে। একইভাবে সর্বজনীন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ২১ ধারা অনুযায়ীও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সত্যিকার নির্বাচন করতে বাধ্য। আর ভোটারদের সম্পৃক্ততা ও প্রধান দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালিত হলেই সেই নির্বাচনকে সঠিক বলা যেত।
সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর এ নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তথা মানসম্মত। আর মানসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে ‘রিজার্ভয়্যার অব পাওয়ার’ অর্থাত্ অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে। (সূত্র : আফজাল হোসেন বনাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ডিএলআর ৪৫)। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের ১১৯ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমনকি আইনি বিধানের সঙ্গে সংযোজন করার যে ক্ষমতা সাধারণত নির্বাচিত সংসদের জন্য নির্ধারিত ‘ইনহেরেন্ট’ বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে (আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম, ৪৫ ডিএলআর)। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানই নয়, বরং সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
কিন্তু ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোটার নির্বাচনের দিনের আগেই তাদের ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ১৫৩ প্রার্থী জনগণের ভোট ছাড়াই ‘জনপ্রতিনিধি’ নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭টি আসনে মাত্র ৩৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এমনকি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও প্রার্থী সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এবারকার নির্বাচনে ৪১টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে মাত্র ১২টি দল অংশ নিয়েছে যারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক। নির্বাচনের আগেই নিজেদের মধ্যে আসন ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছে। এতে করে কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। যা ছিল তা একেবারেই পাতানো এবং সাজানো।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বার বার বলেছেন, সাংবিধানিক মূল চেতনা কেবল নির্বাচন করা নয়, একটা মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই নির্বাচনকে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন না বলে, গণতন্ত্র হত্যার নির্বাচন বলাই শ্রেয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ২০১০ সালের মে মাসের রায় থেকে শুরু করে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন, পর্যবেক্ষহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে যেভাবে দাফন করা হয়েছে তাতে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন ‘গণতন্ত্রের গোরখোদক’ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকীব উদ্দিন।
উৎসঃ   আমার দেশ