বিশেষজ্ঞরা বলছেন : সংবিধান, আরটিআই ও তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক শতবর্ষী এ আইন
‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’। প্রায় একশ বছরের পুরনো এ আইনটি করার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এমনটাই বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। অতি সম্প্রতি হঠাৎ করেই এটি প্রয়োগ করা হয়েছে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আদৌ প্রয়োগ করা যায় কিনা- এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শুধু তাই নয়, আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত এ আইনটির বর্তমান সময়ে এসে প্রয়োগ দেশের সংবিধান, ২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইন (আরটিআই) এবং ২০১১ সালে প্রণীত জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
জানা গেছে, ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সরকারি নথির গোপনীয়তা রক্ষায় প্রণয়ন করে এই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। এর পর শুরু হয় পাকিস্তান আমল। সেটি পেরিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন প্রণীত ‘দ্য বাংলাদেশ ল’জ (রিভিশন অ্যান্ড ডিক্লারেশন) অ্যাক্টের দ্বিতীয় তফসিলে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে সরকারি গোপনীয়তা সংক্রান্ত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি আত্তীকরণ করে বাংলাদেশ। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আইনটির প্রয়োগের কোনো নজির কারও জানা নেই।
গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী বাদী হয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় তার বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালের দ-বিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারার এবং অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারার অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। দ-বিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় রয়েছে চুরির অভিযোগ। এই দুটি ধারার সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের’ ৩ ও ৫ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে। ৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর ৫ ধারা অনুযায়ী সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে অথবা ১৪ বছরের কারাদণ্ড। তবে সর্বনিম্ন সাজা ৩ বছরও হতে পারে।
এ ব্যাপারে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলিস্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম উল্লেখ করেছেন, দণ্ডবিধি দিয়ে সাধারণত চোরের বিচার করা হয়। রোজিনা আসলে কী চুরি করেছেন? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করে কিছু ছবি তুলেছেন। এই ফোন এখন পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। কিন্তু তিনি যা করেছেন, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে এবং দেশের জনগণের স্বার্থে করেছেন। সেখানে তার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই, সাংবাদিকতা এবং জনস্বার্থে করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারাটিতে ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই গুপ্তচরবৃত্তি তখনই সংঘটিত হয়, যখন কেউ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তা ‘শত্রু’ দেশের হাতে তুলে দেন। কিন্তু এখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ আইনের ধারা ৫-এ ‘সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ’ এবং ‘কর্মকর্তাদের বেআইনি যোগাযোগের’ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আবারও বলতে হচ্ছে, একান্ত সচিবের কক্ষ ‘সংরক্ষিত’ এলাকা নয় এবং সেখানে বেআইনি কিছু করা হয়নি। এমনকি রোজিনা সেখানে এমন কিছুই করেননি, যার জন্য তাকে হেনস্তা করা যায়।
মাহফুজ আনাম লিখেছেন, আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, বাক্স্বাধীনতাবিরোধী এবং বিতর্কিত আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩, যা এখনো বিদ্যমান। এই আইন আমাদের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া এই আইন তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ আইনে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, এর ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যে কোনো আইনের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে আরটিআই। এর অর্থ হলো, আরটিআই যত দিন আছে, তত দিন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কার্যকর হবে না বা আরটিআই দ্বারা এটি রহিত হবে।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর মতো অনেক আইন করেছে। কারণ তাদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয় ছিল। তখন সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের প্রচলন বা বিকাশও খুব একটা ছিল না। কিন্তু আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে যে বিষয়গুলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে, তার মধ্যে মতপ্রকাশের বা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও কিছু কিছু আইন রয়ে গেছে। তবে এগুলোর খুব একটা ব্যবহার নেই। এখন হাঠাৎ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনটির ব্যবহার আমি বলব আইনের অপপ্রয়োগ। আইনগতভাবে এ আইনটি প্রয়োগের সুযোগও নেই।’
মানবাধিকার প্রশ্নে বহু মামলা পরিচালনাকারী এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি জড়িত। বিশেষ করে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তথ্য বের করা এখন রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য খুবই প্রয়োজন। এ অবস্থায় এসব আইন দিয়ে সাংবাদিক, সংবাদ মাধ্যমকে কোণঠাসা করার যে চেষ্টা, তা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে যায় না। আর মামলা যারা করেছে তারা না বুঝেই করেছে।’
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, ‘২০১১তে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন পাস হয়েছে, কিন্তু এ আইনের ব্যবহার নেই। সাংবাদিকরাও এ আইনের সুযোগ নেননি।’ ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর সঙ্গে এ আইনের সাংঘর্ষিক দিক তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘দুটো আইন কীভাবে সাংঘর্ষিক হয়েও এখনো ব্যবহার হচ্ছে, সেটি দেখার বিষয়। রোজিনা ইসলাম যদি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য নিয়েও থাকেন, তা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়ার কথা এবং রোজিনাকে পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল।’
সাংবাদিক কামাল আহমেদ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এ আইনে এর আগে কোনো সাংবাদিক অভিযুক্ত হয়েছেন, এমন নজির আমাদের জানা নেই। আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতোই আমরাও এ আইন প্রয়োগের অন্য কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছি না। কেননা, আইনটি প্রধানত সরকারি কর্মচারীদের জন্যই প্রযোজ্য, যাদের বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় বা স্পর্শকাতর তথ্য ও নথিপত্র নিয়ে কাজ করতে হয়। বিপরীতে সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে যাতে জনস্বার্থ আছে, এমন যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করে, তা প্রকাশ করা। বিশ্বজুড়েই জনস্বার্থে সাংবাদিকরা গোপনীয় তথ্য, এমনকি যুদ্ধকালীনও সামরিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করে থাকেন। পেন্টাগন পেপার্সই হোক, কিংবা ব্রিটিশ এমপিদের অন্যায্য ও ভুয়া ভাতা উত্তোলনের তথ্যই হোক- সাংবাদিকরা গোপনীয় নথির কপি হাতে পেয়েই এসব সাড়া জাগানো প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রতিবেশী ভারতে বোফর্স কেলেঙ্কারি কিংবা রাফায়েল কেলেঙ্কারির তথ্যও সাংবাদিকরা যে প্রকাশ করেছেন, তা-ও গোপন নথির ওপর ভিত্তি করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো এত শত বছরের পুরনো আইনটিও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের একটি হাতিয়ার বলে মনে করেন এই বিশিষ্ট সাংবাদিক।