উত্তর পতেঙ্গা পূর্বকাটগড় কে জি স্কুল ভোটকেন্দ্রের পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন বৃদ্ধ জমির আলী। ভোট দিয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন করতেই ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দেন এটা ‘কিসের ভোট? এমন ভোট তো কখনো দেখিনি। ভোটের মিছিল নাই, মিটিং নাই, প্রার্থী নাই, মার্কা নাই কাকে ভোট দেব?’ নির্বাচনের নামে প্রহসনে শরিক হননি জমির আলীর মত অনেক ভোটার।
একদলীয় নির্বাচন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে চট্টগ্রামের ভোটারেরা। গণতন্ত্রকামী জনতার সম্মিলিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধে ভেসে গেছে প্রহসনের ভোট। একদলীয় নির্বাচন পুরোপুরি তামাশায় পরিণত হওয়ায় উজ্জীবিত এ অঞ্চলের ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। একদলীয় ভোটারবিহীন এ নির্বাচনে বিজয়ীদের গণদুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গণধোলাই দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল। বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রই ছিল ফাঁকা, ভোটারশূণ্য। কেন্দ্রে ছিলনা প্রার্থীদের কোন এজেন্ট। সরকার দলীয় ক্যাডার মাস্তানদের অনেকে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ভোট দিতে যায়নি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। প্রতিবেশী একটি দেশের বিশেষ সংস্থার ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু ভোটারদেরও পুরোপুরি কেন্দ্রমুখী করা যায়নি।
এর ফলে একদলীয় একতরফা নির্বাচন ভোটারবিহীন নির্বাচনে পর্যবসিত হলো। উত্তর পতেঙ্গা পূর্বকাটগড় কেন্দ্রে ভোটার দুই হাজার ৮৮। ভোট দিয়েছেন মাত্র ১২৬ জন। নারিকেলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন হাজার ১৬১ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন মাত্র ১১২ জন। মহানগরীর প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের চিত্র ছিল এমন। তবে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভোটারের হার ছিল কিছুটা বেশি। পতেঙ্গা জেলে পাড়ার ভোটকেন্দ্র পতেঙ্গা হাই স্কুলের একটি বুথে ৪২৪ জন ভোটারের মধ্যে ২২১ জন ভোট দিয়েছে। একই এলাকার মুসলিম পাড়া কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। সকাল ৮টায় ভোট শুরু হলেও অনেক কেন্দ্রে ১০-১১টা পর্যন্ত কোন ভোটার পাওয়া যায়নি।
ভোটারদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয়নি। শনিবার রাতে মহানগরী ও জেলার প্রায় প্রতিটি এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। বোমা ককটেল পড়েছে সরকারী দলে প্রার্থী এম এ লতিফের গোসাইলডাঙ্গার বাড়িতে। জাতীয় পার্টিতে আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত জিয়াউদ্দিন বাবলু মহানগরীর ৯ আসনে নির্বাচন করছেন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে। ওই বাসাতেও বোমা হামলা হয়েছে। সাতকানিয়ায় নৌকার প্রার্থী আবু রেজা নদভীর গাড়ির বহরে বোমা পড়েছে। ফটিকছড়ির নিশ্চিন্তাপুরে ক্ষুব্ধ ভোটারদের রোষানলে পড়ে কানে ধরে ক্ষমা চেয়ে উদ্ধার হয়েছেন তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি আওয়ামী লীগ সমর্থিত নজিবুল বশর মাইজভা-ারী। বারবার দল বদলানো বিতর্কিত ভা-ারীকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে নাজেহাল করে স্থানীয়রা।
সাতকানিয়ার ঢেমশা বড়–য়াপাড়া, চরতিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা ভোটকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর পুলিশ ও কর্মকর্তাদের মারধর করেছে। চরতির বেশ কয়েকটি কেন্দ্র থেকে জনতার প্রতিরোধের মুখে ভোটের সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যায় পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা। গতকাল সকালে বিডিআর পাহারায় কেন্দ্রে আসলেও সেখানে ভোটার যায়নি। রাতেই কয়েকটি কেন্দ্রে মলমূত্র নিক্ষেপ করে ক্ষুব্ধ ভোটারেরা। সীতাকু-ে কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ মানুষ। লোহাগাড়ায় ব্যালট বাক্স ছিনতাইকালে জনতার উপর পুলিশ গুলি ছুঁড়লে এক শিবির কর্মী মারা যায়। দিনভর ভোটকেন্দ্রমুখী জনতার বিক্ষোভ মিছিল, ব্যাপক বোমাবাজিতে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার ১৬টি সংসদীয় আসনের ৯টিতে ভোট হয়। বাকি ৭টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীরা। ৭টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিপরীতে যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা একেবারেই নতুন এবং নাম-পরিচয়হীন। তবে তাদের সাথেও ভাল আচরণ করেনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও তাদের ক্যাডারেরা। কোন কোন এলাকায় প্রার্থীর লোকজন দলীয় ক্যাডার এবং থানা-পুলিশ মিলে নৌকায় সিল মেরে বাক্সভর্তি করেছে। এর প্রতিবাদে পটিয়া আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেলা ২টায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হয়ে মধুচন্দ্রিমায় রয়েছেন। আর এ সময়ে চট্টগ্রামে তার দলের একমাত্র প্রার্থী হায়দার আলীকে বাঁশখালী কেন্দ্রের আশপাশেও ঘেষতে দেয়নি আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা। এজেন্টদেরকে বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখলে নিয়ে নৌকায় সিল মারার প্রতিবাদে তিনিও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। আনোয়ারা আসনে নাঙ্গলের প্রার্থী তপন চক্রবর্তীও তার প্রতিদ্বন্দ্বি সাইফুজ্জামান জাভেদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দিয়ে গায়ের জোরে ভোটের বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ আনেন তিনি।
মহাজোটে শরিকেরাও কেন্দ্র দখল নিয়ে কামড়াকামড়ি করেছেন। নগরীর কোতোয়ালী আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী আবু হানিফ অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিয়াউদ্দিন বাবলুর লোকজন মেডিক্যাল কলেজ, চর চাক্তাইসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। বাবলুর পক্ষে আওয়ামী ক্যাডারেরা গণহারে জাল ভোট দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফটিকছড়িতে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী ভা-ারীর বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ আনেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ড. মাহমুদ হাসান।
নগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ কেন্দ্র, জামালখান ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, পশ্চিম বাকলিয়া প্রাইমারী কেন্দ্র, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্র, বাকলিয়া ল্যাবরেটরী উচ্চ বিদ্যালয়সহ নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্র সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায় কেন্দ্রগুলো ভোটারশূন্য। নগরীর জামালখান কেন্দ্রের সামনে সকাল ১১টায় ৪০ মিনিটে দুর্বৃত্তরা পরপর তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে কেন্দ্রের আশেপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাকলিয়া সরকারী ল্যাবরেটরী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ১টায় বহিরাগতরা ঢুকে পড়লে প্রায় এক ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. আইয়ুব নুরী জানান, বহিরাগতরা কেন্দ্রে ঢুকে পড়ায় ভোটগ্রহণ আধঘণ্টা বন্ধ ছিল। পরে র্যাব-পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই কেন্দ্রের মহিলা বুথে ঢুকে বহিরাগতরা ২শটির মত জাল ভোট দিয়েছে বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১৭নং বাকলিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহীদুল আলম ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ভোটারদের ভোট প্রদানে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আতঙ্কের কারণে কেন্দ্রে উপস্থিতি কম হয়েছে। বেলা ২টা পর্যন্ত উল্লেখিত কেন্দ্রগুলোর পুরুষ ও মহিলা বুথের প্রত্যেকটিতে মাত্র ৪০ থেকে ৬০টি ভোট পড়ে। এদিকে দুপুর দেড়টায় নগরীর বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন ন্যাশনাল প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র থেকে ককটেলসহ একজনকে আটক করে পুলিশ।