২০১৬ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন বাবুল আক্তার। সে সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানসহ নানা সাহসী পদক্ষেপের কারণে আলোচিত ছিলেন তিনি। তখন বাবুলের বেশকিছু অভিযানে ছায়াসঙ্গী হিসেবে কাজ করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা। এক সময় সিএমপিতে কর্মরত এই কর্মকর্তা বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মিতু হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া প্রথম মামলাটিও তদন্ত করেছেন সন্তোষ। ওই ঘটনায় সাবেক ‘গুরু’ বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন তিনি। এর ভিত্তিতেই মিতুর বাবার করা নতুন মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাবুল আক্তারকে।
জানা গেছে, কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনের সময় গায়ত্রী অমর সিং নামে এক বিদেশি এনজিও কর্মীর প্রেমে পড়েন বাবুল আক্তার। পরবর্তীতে বাবুল সুদানে মিশনে গেলে বাসায় থাকা মোবাইলের সূত্র ধরে সেই প্রেমের সম্পর্ক জেনে যান বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু। হত্যাকাণ্ডের কয়েকমাস আগে বাবুল চীনে গেলে মিতুর হাতে আসে দুটি বই। ওই বইয়ের একাধিক পাতায় দুজনের হাতের লেখায় ওঠে আসে তাদের প্রেমের আদ্যোপান্ত। বাবুল আক্তার দেশে ফিরলে বিষয়টি পারিবারিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা করে মিতুর পরিবার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এর কিছুদিন পর বাবুল আক্তার তার সোর্স ও বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে খুন করান মিতুকে। হত্যাকাণ্ডে ধামাচাপা দিতে শোকের অভিনয় করেই নিজেই করেন মামলা। শেষ পর্যন্ত তাতেও রেহাই মেলেনি। দীর্ঘ পাঁচ বছরের তদন্ত শেষে স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ডের তার সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ।
বুধবার বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। ওই মামলার বাকি সাত আসামি হলেন- মো. কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা (৪০), এহতেশামুল হক ওরফে হানিফুল হক ওরফে ভোলাইয়া (৪১), মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম (২৭), মো. আনোয়ার হোসেন (২৮), মো. খায়রুল ইসলম ওরফে কালু (২৮), সাইদুল ইসলাম সিকদার (৪৫) ও শাহজাহান মিয়া (২৮)।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এরপর মামলাটি তদন্ত করে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আবু নসুর গুন্নু, শাহ জামান ওরফে রবিন, সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান, মো. আনোয়ার ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিমকে আটক করে পুলিশ।
এ হত্যার ঘটনায় অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে আটক হন এহেতাশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনির। তাদের কাছ থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়, যা মিতু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে বলে পুলিশ তখন দাবি করেছিল।
গ্রেফতার আনোয়ার ও মোতালেব মিতু হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তাদের স্বীকারোক্তিতে মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম আসে বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে পরিচিত মো. মুছার।
মিতুর বাবা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারকে দায়ী করেন। তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে অভিযোগ সাপেক্ষে বেশকিছু তথ্য দেন বলে জানান মোশাররফ হোসেন। ২০১৭ সালের ২৪ জুন রাতে রাজধানীর বনশ্রীর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দীর্ঘদিনেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত মামলাটির তদন্তভার আদালতের নির্দেশে গত বছরের জানুয়ারিতে চলে যায় পিবিআইতে।
এরপর ঘুরতে থাকে মামলার তদন্তের মোড়। একপর্যায়ে পিবিআইয়ের হাতে আসে ২৭ সেকেন্ডের একটি কল রেকর্ড। হত্যাকাণ্ডের দিন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে মুছা নামের এক ব্যাক্তির মোবাইল ফোন করেন বাবুল আক্তার। সালাম দিয়ে মুছা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল আক্তার বলেন, ‘তুই কোপালি ক্যান?’ ৩ থেকে ৪ সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, ‘বল তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি?’ এর পর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন বাবুল আক্তার।
এরই মধ্যে মামলার অন্যতম আসামি কারাবন্দি মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিমের জামিন শুনানিতে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ মামলা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ জানুয়ারি মিতু হত্যা মামলায় তদন্তের সর্বশেষ লিখিত অগ্রগতির তথ্য সংবলিত প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ প্রতিবেদন দেন। এসবের পরেও কোনো এক অজানা কারণে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিচ্ছিল না পিবিআই।
পিবিআই জানায়, মঙ্গলবার বাবুল আক্তার মামলার বাদী হিসেবে তদন্ত কার্যক্রম জানতে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে যান। সেখানে তাকে সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে হেফাজতে নেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারের বিষয়টি বিভিন্ন সাংবাদিককে নিশ্চিত করেন। পরে মামলার বাদীকে আইনি জটিলতার কারণে গ্রেফতার করতে না পারায় বিষয়টি এড়িয়ে যান পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন পিবিআই প্রধান ও পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। নতুন মামলা হলেই তিনি গ্রেফতার হবেন। মিতুর বাবা বাদী হয়ে মামলা করবেন। সেই মামলায় বাবুল আক্তারকে আজ গ্রেফতার দেখানো হবে এবং আগের মামলা ফাইনাল রিপোর্ট দেবে পুলিশ। মিতুর বাবা বাদী হয়ে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে মামলা করবেন। এজাহার প্রস্তুত করা হয়েছে।’
এর কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় নতুন মামলা হয়। সেই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পিবিআই বাবুল আক্তারকে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহানের আদালত বাবুল আক্তারকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার এজাহারে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাবুল আক্তার সুদানে মিশনে কর্মরত থাকাকালে তার মোবাইল নম্বরে গায়ত্রী ২৯ বার মেসেজ দেন। এই মেসেজগুলো মিতু তার একটি খাতায় নিজ হাতে লিখে রাখে।
‘তালিবান’ বইয়ের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ওই নারী নিজ হাতে একটি বার্তা লিখে দেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘আমাদের ভালো স্মৃতিগুলো অটুট রাখতে তোমার জন্য এই উপহার। আশা করি এই উপহার আমাদের বন্ধনকে চিরস্থায়ী করবে। ভালোবাসি তোমাকে।’
একই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় গায়ত্রী তাদের প্রথম দেখা, প্রথম একসঙ্গে কাজ করা, প্রথম কাছে আসা, মারমেইড হোটেলে ঘোরাফেরা, রামু মন্দিরে প্রার্থনা, রামুর রাবার বাগানে ঘোরাফেরা এবং চকরিয়ায় রাতে সমুদ্রের পাশ দিয়ে হাঁটা ইত্যাদি স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
এছাড়াও ‘বেস্ট কেপ্ট সিক্রেট’ বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় গায়ত্রীর নিজ হাতে ‘তোমার ভালোবাসার গায়েত্রী’ (ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা) লেখা ছিল।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, মিতু হত্যার তিন দিন পর বাবুল আক্তার গাজী আল মামুন নামে এক ব্যক্তিকে তিন লাখ টাকা দেয়ার জন্য ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হককে বলেন। টাকা পেয়ে গাজী আল মামুন ওই টাকা মুসা, ওয়াসিমসহ আসামিদের ভাগ করে দেন। খুন হওয়ার পর বাবুল আক্তার তদন্ত কর্মকর্তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন জঙ্গিদের আক্রমণে মিতু খুন হয়েছেন। অথচ সিসিটিভি ফুটেজে বাবুল আক্তার তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী এহতেশামুল হক ভোলা ও মুসাকে চেনেও না চেনার ভান করেছেন।