ব্রেকিং নিউজ
Home / নির্বাচিত কলাম / ‘জাতির পিতা’র বুলেট-বৃষ্টি নববর্ষে

‘জাতির পিতা’র বুলেট-বৃষ্টি নববর্ষে

|| মাসুদ রানা ||
Masud Rana

Masud Rana

নিহত-আহত ও স্মৃতি-বিস্মৃতি
ইতিহাস-খ্যাত সংগ্রামে যাঁরা নিহত, তাঁদের কথা আমরা জানি। তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমরা শ্রদ্ধা জানাই, পুষ্পার্ঘ্য দিই। কিন্তু আহতদের কথা কি আমরা মনে রাখি? নিহতরা চলে যান সব দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে, সে কথা আমরা স্বভাবতঃই জানি। কিন্তু যাঁরা আহত হয়ে বেঁচে থেকে স্বাভাবিকতার চেয়ে অনেক-অনেক কষ্টকর জীবন সংগ্রাম করেন, তাঁদের কথা আমরা কতোটুকু জানি?

ঠিক চল্লিশ বছর আগে ১লা জানুয়ারী, নববর্ষে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্দেশে পুলিসের গুলিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে নিহত হন মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদিরুল ইসলাম। আহত হন অনেক ছাত্র-ছাত্রী, যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ১৪ বছরের স্কুল-ছাত্র পরাগ।

গতকাল লণ্ডনে সিপিবি-বাসদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংহতি দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা হয়ে এসেছিলেন সেদিনের সেই চতুর্দশ বর্ষীয় কিশোর আর আজকের  চতুর্পঞ্চদশ বর্ষীয় মীর মাহফুজ আলি ওরফে পরাগ মাহমুদ।

বাংলাদেশের মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারীতে স্বাধীন দেশে প্রথম ছাত্র-হত্যার ঘটনাটি। সম্ভবতঃ দিবসটির যথার্থ উদ্‌যাপনের অভাবে। গতকাল লণ্ডনে অনুষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংহতি দিবসের অনুষ্ঠানটি পুরনো বইয়ের ধুলিধূসর মলাটের উপর ফুঁৎকারে প্রচ্ছদ দেখার মতো জাগিয়ে তুলেছিলো সেই দিনটির ছবি।

১৯৭৩-এর নববর্ষে বুলেট-বৃষ্টি
আজ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির যিনি সভাপতি, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, তিনি ৪০ বছর আগে ১৯৭৩ সালে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ ডাকসুর নির্বাচিত সহ-সভাপতি। সেদিন সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা ভিয়েতনামে মার্কিন হামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঢাকায় মার্কিন তথ্যকেন্দ্র’র সামনে বিক্ষোভ জানাতে গিয়েছিলেন।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ যেমনটি করছে আফগানিস্তানে কিংবা যেমনটি করেছে লিবিয়াতে ও ইরাকে, তেমনি ভিয়েতনামে চার দশক আগে গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো ‘নাপাম’ বোমার আঘাতে। লক্ষ-লক্ষ ভিয়েতনামী নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ প্রাণ হারিয়েছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র আক্রমণে।

কিন্তু ভিয়েতনামী জনগণ কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সে-দিন এক অভূতপূর্ব গেরিলা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সামরিক শক্তি মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। কারণ তাঁরা জনগণের মধ্যে থেকে জনগণকে নিয়ে লড়াই করেছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে।

সে-দিন পৃথিবীর দেশে-দেশে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও, ভিয়েতনামের মুক্তিকামী লড়াকু মানুষের পক্ষে মিছিল হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী এই সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলো ছাত্রসমাজ – ইউরোপে, আমেরিকায়, লাতিন আমেরিকায়, আফ্রিকায় ও এশিয়ায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলো সুদূর বাংলাদেশের ছাত্রসমাজও।

বুলেট-বেঁধা কিশোর পরাগ
সেদিন বাড়ী থেকে নাস্তা না করে পরাগ মাত্র ৫ পয়সা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। সেই ৫ পয়সায় বাসভাড়া দিয়ে তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব হয়েছিলো নিউমার্কেট পর্যন্ত। তারপর বাকী পথ পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন পরাগ। সেখান থেকে মিছিলের সাথে গিয়েছিলেন বর্তমান ঢাকা প্রেসক্লাবের বিপরীতে অবস্থিত তৎকালীন ‘যুক্তরাষ্ট্র তথ্য কেন্দ্র’র সামনে।

মুক্তিযোদ্ধা সেলিম কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিশোর পরাগ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বিক্ষোভের জবাবে মিলবে বুলেট-বৃষ্টি। চল্লিশ বছর আগের ১লা জানুয়ারীর ঘটনা আজও পরাগের স্মৃতিতে দুঃস্বপ্নের মতো জেগে আছে। পরাগ বললেন, তিনি ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সাথে-সাথে। তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে জানালেন, কিছু উত্তেজিত ছাত্র পুলিসের দিকে ছুঁড়বেন বলে ঢিল কুড়োচ্ছিলেন। তখন সেলিম নির্দেশ দিলেনঃ ‘কোনো ঢিল ছোঁড়া যাবে না। শুধু বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে।’

পরাগ নিশ্চিত করেন, সেলিমকে তিনি এ-কথা বলতে নিজ কানে শুনেছেন। সুতরাং কোনো প্রকারের উস্কানি ছিলো না ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। কিন্তু এ-সময়েই এক পুলিস-সদস্য এসে সেলিমের মাথায় থ্রী-নট-থ্রী রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষিত সেলিম দু’হাত তুলে নিজের মাথাটা বাঁচাতে পারলেও হাতে আঘাত পেয়েছিলেন।

স্বভাবতঃই ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের প্রিয়তম নেতার উপর পুলিসের আক্রমণ দেখে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং পুলিসের দিকে ঢিল ছুঁড়তে থাকেন। সে-দিন মিছিলে না-ছিলো চাপাতি, না ছিলো বোমা, না ছিলো মলোটভ ককটেইল। শুধু ছিলো ঢিল-ছোঁড়া ও স্লৌগান-দেয়া প্রতিবাদ। এর জবাবে আসতে পারতো লাঠি চার্জ, টিয়ারগ্যাস কিংবা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি।

যে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তাঁদের শান্তিপ্রিয়তার জন্য প্রায়শঃ ‘হারমোনিয়াম পার্টি’ বলে উপহাসিত হয়ে থাকেন, সেই সংগঠনের কর্মীদের হটিয়ে দেবার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গুলিবর্ষণের হুকুম দিলো। দীর্ঘ ২৫ মিনিট গুলি বর্ষণ হলো!

পরাগ জানান, এটি ছিলো তাঁর কল্পনারও বাইরে – অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা বাবা ও মামার কাছ থেকে ‘ক্রলিং’ শিখেছিলেন বলে সেই শিক্ষা ব্যবহার করে বুলেট-বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা থেকে ‘ক্রল’ করে প্রেসক্লাবের সামনের বাস-ছাউনিতে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। গুলি সেখানেও আসছিলো। কৈশোরের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি থেকে পরাগ বললেনঃ

‘মামা সাংবাদিক ছিলেন বলে জানতাম, যুদ্ধের মধ্যে সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ করা হয় না। তাই প্রেসক্লাবের প্রাঙ্গনে ঢুকে প্রেসক্লাব ভবনের দিকে ছুটতে লাগলাম। ঠিক তখনই দেখলাম পুলিস আমাকে তাক করে গুলি ছুঁড়লো। আমি পড়ে গেলাম। স্বপ্নে সাপ দেখে ভয় পেয়ে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করলে যেমন আওয়াজ আসে না, তেমনি শতো চিৎকার করেও আমার কন্ঠ থেকে কোনো আওয়াজ বের করে আনতে পারছিলাম না।’

এক সময় জ্ঞান হারান পরাগ। অনেকের সাথে তাঁকে নেয়া হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান পরাগ।

মার্কিন-নীতি ও শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশ তখন কেবল সদ্য স্বাধীন দেশ। মাত্র এক বছর ১৫ দিন আগে এসেছে বিজয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে। জাতি যুদ্ধ করেছে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। কারণ তিনি ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার কথা বলে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কিন্তু সেই যুদ্ধে তিনি সশরীরে নেতৃত্ব দেবার চেয়ে শত্রুসেনার হাতে বন্দী হওয়াই শ্রেয় মনে করেছিলেন কোনো এক অঘোষিত সমীকরণে।

সেই নেতাই যে শত্রু-দেশের কারাবন্দীত্ব থেকে ফিরে এসে মুক্ত-দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ছাত্র-মিছিলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিবেন, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরাগ কিংবা স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধা সেলিম।

সেলিমেরা কমিউনিস্ট-আদর্শের কারণে ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী। আর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর গুরু হোসেন সোহরাওয়ার্দী পুঁজিবাদী আদর্শিক কারণেই ছিলেন মার্কিন-সহযোগী। এই মেরুকরণ আকস্মিক নয়। এর ইতিহাস আছে। এ-নিয়ে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলয় গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইউরোপে যেমন প্রতিষ্ঠা করেছিলো ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রীটি অর্গেনাইজেশন), তেমনি এশিয়াতে প্রতিষ্ঠা করেছিলো সিয়েটো (সাউথঈস্ট এশিয়ান ট্রীটি অর্গেনাইজেশন) ও সেন্টো (সেন্ট্র্যাল ঈস্টার্ণ ট্রীটি অর্গেনাইজেশন)। এশিয়াতে পাকিস্তান ছিলো নির্ভরযোগ্য মার্কিন-বান্ধব।

সেই সময়ে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মার্কিন-সহযোগী অংশের নেতা ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান। আর, মার্কিন-বিরোধী ছিলেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫৭ সালে মার্কিন চুক্তিতে পাকিস্তানের স্বাক্ষর করা না-করা নিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরে চুক্তি-বিরোধীদের শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা করেননি। নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিলো পাক-মার্কিন চুক্তি-বিরোধী আওয়ামী লীগ কর্মীদের। সেদিন ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানের গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেনঃ

‘শহীদ, তুমি আজ আমাকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সমর্থন করতে বলছো। তুমি যদি আমাকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো, আমি বলবো, ‘না’! তুমি যদি আমাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করো আমি বলবো ‘না’! ‘না’! তুমি আমাকে যদি আমার কবরে গিয়েও জিজ্ঞাস করো সেখান থেকে আমি চিৎকার করে বলবো, ‘না’! ‘না’! ‘না’!

কোনো ব্যক্তিকে তাঁর বিকাশের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করা ভুল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর উত্তরসূরী শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আদর্শিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক। শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো প্রয়োজন ছিলো যে, ভিয়েতনাম প্রশ্নে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে পাকিস্তান আমলেও দাঁড়িয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ আমলেও দাঁড়াবেন। কারণ, তিনি সমর্থক ছিলেন সেই সিয়েটো চুক্তির, যে চুক্তিতে ভিয়েতনামকে ‘রক্ষা’র নামে আক্রমণ করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভূক্ত ছিলো। এই সিয়েটো চুক্তির উল্লেখ করেই ভিয়েতনামে মার্কিন অভিযানের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ১৯৫৭ সালে নেতা হয়ে নিজদলের কর্মীদের মার্কিন-বিরোধিতা সহ্য করেননি, সেই তিনি ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘কমিউনিস্ট-ছানাপোনাদের’ মার্কিন-বিরোধিতা সহ্য করবেন, এটি হতেই পারে না।

১৯৭৩ সালের প্রথম দিবসে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলি বর্ষণ করে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পুরনো অবস্থান পরিবর্তন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান সেই মার্কিন আস্থা লাভ করতে চেয়েছিলেন, যা হারাবার আশঙ্কায় তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে উপস্থিত থেকে ভিয়েতনামের মতো ‘গেরিলা’ নামে চিহ্নিত হতে চাননি।

শ্রেণীর ঊর্ধ্বে ব্যক্তির কোনো রাজনৈতিক অবস্থান হতে পারে না। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সেই শ্রেণীর দল, যাঁরা বিকাশোন্মুখ কিংবা বিকশিত বাঙালী ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সচল ও রক্ষাকল্পে, বিশ্ব-পুঁজিবাদের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা ও সহযোগিতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে পারে। এই বোধ সে-দিন যেমন সত্য ছিলো, আজও তেমনই সত্য আছে।

ভিয়েতনামে যেমন আদি ফরাসী উপনিবেশ রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো, পূর্ব-বাংলায়ও সেদিন পাকিস্তানী উপনিবেশ রক্ষার জন্য তার প্রস্তুতি ছিলো। কিন্তু সে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে বঙ্গপোসাগরের দিকে ‘সেভেন্থ ফ্লীট’ পাঠালো, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘টেন্থ অপারেটিভ ব্যাটল গ্রুপ’-এর কমাণ্ডার ভ্লাদিমির ক্রুগলিয়াকভ জাহাজ-বিধ্বংসী মিসাইল সজ্জিত ক্রুইজার, ডেস্ট্রয়ার ও আণবিক সাবমেরিন নিয়ে মার্কিনীদের পথ রোধ করেন। তিনি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’-এর উপর মিসাইল তাক করে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলে মার্কিনীরা টু শব্দটি না করে ফিরে যায়।

একাত্তর সালে নয় মাসে পাকিস্তানী হানাদারেরা যা করেছিলো, মার্কিন সামরিক উপস্থিতিতে সেটি আরও দীর্ঘতর হতে পারতো। হত্যা-ধর্ষণ-ধ্বংসের পরিমাণ হতে পারতো অনেক-অনেক গুণ বেশি, যদি না সেদিন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়াতো। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ববোধ ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের অগ্রগামী অংশ বুঝেছিলো, স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও টিকিয়ে রাখতে গেলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনা ও সংগ্রাম জারি রাখা জরুরী। সেই বোধেই ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার।

ছাত্র ইউনিয়নের মুজিব-অনুভূতি
সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের উপলব্ধি কী ছিলো, তা বুঝার জন্য ‘দৈনিক সংবাদে’ প্রকাশিত প্রতিবেদনের পুনর্পাঠ করা যেতে পারেঃ

গতকাল মঙ্গলবার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে শহীদ মতিউল ইসলাম ও শহীদ মির্জা কাদিরুল ইসলামের লাশকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিম্নোক্ত ঘোষণা পাঠ করেন।

‘‘এই সমাবেশের সামনে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে, বিগত ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলাম ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আজ সেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা দেশের আপামর জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে তার বঙ্গবন্ধু বিশেষণ ব্যবহার করবেন না। একদিন ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা শেখ মুজিবকে জাতির পিতা আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার ছাত্রের রক্তে তার হাত কলঙ্কিত করায় আমরা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না। শেখ মুজিবুর রহমানকে একদিন ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। আজকের এই সমাবেশ থেকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হলো।’’  (৩ জানুয়ারী ১৯৭৩, দৈনিক সংবাদ)

সেদিন হরতাল হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো সাম্রাজ্যবাদের দালালী ও দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার। ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রিকাটি লেখেঃ

গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পুলিশের বর্বর গুলি ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এতে সভাপতিত্ব করেন।

সভাশেষে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্মম গুলির শিকার শহীদ মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদেরের লাশ নিয়ে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন শ্লোগান সহকারে শহরের প্রধান রাজপথগুলো প্রদক্ষিণ করে বায়তুল মোকাররমে এসে সমাপ্ত হয়।

বায়তুল মোকাররমে এক বিক্ষোভ সভায় বক্তৃতা করেন ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও ডাকসুর সহ সভাপতি জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও শ্রমিক জনতা যোগদান করে। তারা সোচ্চার কণ্ঠে হত্যার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়।

বিক্ষোভ মিছিলে উচ্চারিত শ্লোগানগুলো হচ্ছে—‘নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই,—এক রশিতে ফাঁসি চাই,’ ‘সাম্রাজ্যবাদের মরণ ফাঁদ—১৯৭৩ সাল,’ ‘শহীদ মতিউল-কাদেরের রক্ত বৃথা যেতে দেব না,’ ‘খুনি মান্নানের— ফাঁসি চাই,’ ‘ভিয়েতনামের বদলা নেব, বাংলাদেশের মাটিতে, ‘আগামীকাল হরতাল, গাড়ির চাকা ঘুরবে না, খুনিশাহী মুজিবশাহী ধ্বংস হোক, ‘নিক্সনের দালালি করা চলবে না,’ ‘সমাজতন্ত্রের নামে ভাওতা দেয়া চলবে না,’ ‘বাংলার মীরজাফর শেখ মুজিব।’ (২ জানুয়ারী ১৯৭৩, দৈনিক সংবাদ)।

সময়ের ব্যবধানে, অবস্থানের পরিবর্তনে, মানুষের চেতনা কীভাবে পাল্টে যায়, তা উপরের সংবাদ প্রতিবেদনের সাথে বর্তমান সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর তুলনা করলে উপলব্ধি করা যায়। ১৯৭৩ সালের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনার প্রকাশের সাথে ২০১৩ সালে তাঁরই নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কী অবাক পার্থক্য! কিন্তু কী এর ব্যাখ্যা?

পরাগের কন্ঠে বুলেটের শিস
চল্লিশ বছর আগে পুলিস ১৪ বছরের পরাগকে লক্ষ্য করে যে গুলিটি ছুঁড়েছিলো, সেটি পরাগের কন্ঠ ভেদ করে চলে গিয়েছিলো। সেদিন পরাগ মরতে পারতেন। অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া পরাগকে লোক দেখানো কর্তব্যের খাতিরে চিকিৎসার নামে লণ্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। সেদিন লণ্ডনে কিশোর পরাগের জীবন-সংগ্রাম কীভাবে শুরু হয় এবং পরিণতি লাভ করে সেটির বর্ণনা হতে পারে একটি পুরোদস্তুর উপন্যাস, যার স্থান এটি নয়।

তবে এটুকু না বললেই নয় যে, অসহায় কিশোর পরাগ তাঁর মুক্তিযোদ্ধা মামার এক গ্রামাত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। কিন্তু অচিরেই পরাগ জানতে পারেন, তাঁর আশ্রয়দাতা ছিলেন পাকিস্তানপন্থী দালাল। পরাগের মুক্তিযোদ্ধা মামার প্রতি ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়ে ঐ আশ্রয়দাতাটি পরাগকে নির্যাতন করতেন, গালাগালি করতেন, অভিসম্পাত করতেন – এমনকি খাদ্য বঞ্চনায়ও রাখতেই। পরাগ জানালেন, তিনি হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিলেন না খেতে পেয়ে।

পরাগের বাঁচার স্পৃহা তাঁকে বের করে নিয়ে আসে সেই আশ্রয় থেকে। তিনি এবার আশ্রয় পান বাঙালী মালিকানাধীন এক রেস্টুরেন্টে। সেখানে তিনি পেট ভরে খেতে পেতেন বটে, কিন্তু অমানবিক শোষণ চলতো তাঁর শ্রমের। তাঁকে বেতন দেয়া হতো মাত্র ৫০ পেন্স। এরই মধ্যে পরাগ নিজেকে দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করেন। তিনি রেস্টুরেন্টের শেফ্‌ হয়ে ওঠেন। এতে তাঁর আয় বাড়ে এবং শ্বাস ফেলার পরিধি তৈরী হয়।

পরাগের বাবা ছিলেন ন্যাশন্যাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের ঢাকা জেলার সম্পাদক। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র ইউনিয়ন করা কিশোর পরাগের জীবন ছিলো সম্ভাবনাময়। সেই সম্ভাবনার দরজা অবারিত করতেই তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধে করেছিলেন। কিন্তু হায়ঃ

নিজের পিতার যুদ্ধে জেতার এক স্বাধীন দেশে
বুলেট ছুঁড়ে কন্ঠ ছিঁড়ে ‘জাতির পিতা’ নববর্ষে

কিন্তু আশা ছাড়েননি ভিন্‌ দেশে বিচ্ছিন্ন কিশোর পরাগ। রেস্টুরেন্ট কাজ করতে-করতেই তিনি ও-লেভেল, এ-লেভেল পাস করলেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করলেন। নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুললেন পরাগ।

পরাগের বিশ্ববোধ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনা লোপ পায়নি। বুলেটে বিক্ষত কন্ঠ নিয়েও আজ মীর মাহফুজ আলি পরাগ ব্রিটেইনের ইংরেজি ভাষার পরিচিত কবি ও আবৃত্তিকার। এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংহতি দিবসের স্মরণ সভায় নিজের কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা আবৃত্তি করে।

পাশে বসে লক্ষ্য করলাম, পরাগের কণ্ঠ উচ্চকিত কিন্তু স্বাভাবিক নয়। বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত পরাগের কণ্ঠের আওয়াজ এখনও তেজস্বী কিন্তু একটু ফ্যাঁসফ্যাঁসে। কারণ, ‘জাতির পিতা’র বর্ষিত বুলেট এখনও শিস্‌ দেয় পরাগের প্রতিটি উচ্চারিত শব্দে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে, প্রতি মুহূর্তে, গত চল্লিশটি বছর ধরে।

বুধবার, ২ জানুয়ারী ২০১৩
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com