•ব্যারিস্টার নাজির আহমদ •
১. মৃত্যুর সংবাদ শুনে কি করা উচিৎ?
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।” বাংলা অর্থ: “আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।” এটি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত বা বাক্যের অংশ (সুরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৫৬)। যে কারো মৃত্যুতে (এমনকি অমুসলমানের মৃত্যুতেও) অথবা যে কেউ বা নিজে বিপদ পড়লে অথবা অন্যের বা নিজের দু:সংবাদ শুনলে এ বাক্যাংশটি পড়তে হয়। এটা ইসলামের সুন্দর আচারিত পদ্ধতি ও নিয়ম। এটি পড়লে যিনি পড়বেন তার সওয়াব হবে – কোরআনের আয়াত হওয়ার কারনে সহিহ হাদিস অনুযায়ী প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে নেকি বা সওয়াব পাওয়া যাবে। আয়াতটি তথা বাক্যটির অর্থ দেখুন – এটি অন্যের জন্য কোন দোয়া নয় যা অনেকে অজ্ঞতা বশত: মনে করে থাকেন। বরং এটি আল্লাহর জিকির তথা আল্লাহকে স্মরন – এটির দ্বারা মহান প্রভু আল্লাহপাকের পরিচয় ও বড়ত্ব প্রকাশ পায়।
আমাদের সবার মৃত্যু অবধারিত। প্রত্যেক প্রানীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১৮৫)। তাই যে কারো মৃত্যুতে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়া উচিত। এটা কোরআন অনুসারে ইসলামের সুন্দর আচারিত নিয়ম ও প্রথা।
২. মৃতু্কে নিয়ে গুজব আশংখাজনক হারে বেড়ে গেছে!
ইদানীং আমাদের দেশে, সমাজে ও কমিউনিটিতে গুজবের মাত্রা বিশেষ করে মৃত্যুকে নিয়ে গুজব রটানো আশংখাজনক হারে বেড়ে গেছে। জীবিত মানুষকে দস্তুর মত মরার আগেই মেরে ফেলা হচ্ছে! সোসাল মিডিয়ায় মৃত্যুর খবর পেলেই হলো – যাচাই-বাচাই না করে বা সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে পট্ করে শেয়ার করে দেয়া হয়। এতে অগনিত মানুষ হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত। প্রচারিত মৃত্যুর সংবাদ নিজের মত, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে হলে তো আর কোন কথাই নেই – তা যাচাই-বাচাইয়ের প্রয়োজনবোধই অনেকে মনে করেন না। পাওয়া মাত্রই প্রচার বা শেয়ার শুরু করে দেন। অনেক প্র্যাকটিসিং মুসলমান ও লেবাসধারী ব্যক্তিকেও এসব কাজ করতে দেখা যায়। আফসুস্, অথচ তারা কি জানেন এসব করে তারা কোরআন ও হাদিস বিরোধী কাজ করে রীতিমত পাপ করে যাচ্ছেন?
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক বলেছেন “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যখন কোনো ফাসেক (পাপাচারী) লোক কোন খবর/সংবাদ দেয় বা নিয়ে আসে, তার সত্যতা তোমরা যাচাই করে নিও যেনো অজ্ঞাতসারে তোমরা কোনো জাতির/গুষ্টির ক্ষতি করে না বসো, যার ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হয়” (হুজুরাত: ৬)। সুতরাং কোন খবর বা সংবাদ পেলে তার সত্যতা যাচাই করা কোরআনের নির্দেশ। আল্লাহপাক অন্যত্র বলেছেন- “যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় তোমার কান, চোখ ও হৃদয় এদের প্রত্যেকটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে”। (সূরা: বনী ইসরাইল-৩৬)। চিন্তা করুন – আমরা যারা গুজব ছড়াই কাল কিয়ামতের ময়দানে আমাদের কান, চোখ ও হৃদয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আমরা কি জবাব দিব?
গুজব যে ছড়ায় সে মিথ্যাবাদি। আমাদের প্রিয় নবী (সা:) বলেছেন, “সব শোনা কথাই প্রচার ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৯২)। মিথ্যা বলে গুজব ছড়ানো মুনাফিকের আলামত। নবী করিম (সা:) বলেছেন “মুনাফিকের আলামত তিনটি : ১. যখন কথা বলে সে মিথ্যা বলে, ২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, ৩. আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে।”(সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩)।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমাদের কাছে কোনো কথা বা সংবাদ এলে আমরা যাচাই-বাচাই করে সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে আমরা সেটি বিশ্বাস করবো না বা অন্যের কাছে বলবো না বা সোসাল মিডিয়ায় শেয়ার করবো না/ছড়াবো না। এটাই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা।
৩. মৃত্যূতে কে কিভাবে “স্বস্তি” পায়, “স্বস্তি” লাভ করে?
গভীরভাবে চিন্তা করুন – নীচের সহিহ হাদিসের আলোকে কেউ মরলে নিজে “স্বস্তি” লাভ করে আবার কেউ মরলে মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই তার কাছ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে “স্বস্তি” বোধ করে। এখন আমাদের জীবন যদি এমন হয় যে আমাদের মৃত্যুতে মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই পরিত্রাণ পেয়ে “স্বস্তি” বোধ করে, তাহলে আমাদের এ জীবনটা সত্যিই বরবাদ। তাই আমরা যারা জীবিত এমন জীবন গঠন করার চেষ্টা করা উচিৎ যাতে মরে আমরা লাভ করি “স্বস্তি” আর মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু পরিত্রাণ পেয়ে “স্বস্তি” বোধ না করে বরং কাঁদে।
এবার আসুন সহীহ হাদিসটি দেখি। হযরত আবু ক্বাতাদাহ ইবনে রিবয়ী আনসারী (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি হাদীস বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) – এর নিকট দিয়ে একটি মানুষের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন–“স্বস্তি লাভকারী এবং তার থেকে স্বস্তি লাভকৃত।” সাহাবীগণ (রা:) জিজ্ঞাসা করলেন – ইয়া রাসূলাল্লাহ! “স্বস্তি লাভকারী এবং তার থেকে স্বস্তি লাভকৃত‘’- এর মানে কী? রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করলেন–“মুমিন বান্দা মৃত্যুবরণ করলে দুনিয়ার কষ্ট ও তাকলীফ থেকে পরিত্রান পেয়ে এবং আল্লাহর রহমত পেয়ে “স্বস্তি” লাভ করে। আর বদকার বান্দা (পাপী ও জালিম) যখন মারা যায় তার কবল সকল মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই (পরিত্রাণ পেয়ে) “স্বস্তি” বোধ করে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৬১৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ১৫৭৯)।
৪. কর্মফলের যথাযথ পরিনাম ভোগ করতে হবে।
নীচে কোরআনের ছয়টি শক্তিশালী ভার্স বা আয়াত দেয়া হলো যেগুলোতে মহান প্রভু দ্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে আমাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী পরকালে বিচার করা হবে বা প্রতিদান দেয়া হবে, কোন জুলুম/বন্চিত করা হবে না এবং একটু অনু-পরমানুও এদিক-সেদিক করা হবে না। মহান আল্লাহপাকের কথা থেকে আর কার কথা এত সত্য, সঠিক ও ওজনওয়ালা হতে পারে? তিনি আহকামুল হাকিম – শ্রেষ্টতম প্রজ্ঞাময় ন্যায়পরায়ন বিচারক। সুতরাং আপনার-আমার কথায় পট্ করে কাউকে জান্নাত, জান্নাতুল ফিরদাউস বা জাহান্নাম দিয়ে দেয়া হবে না বা বন্চিত করা হবে না। প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের ফলাফল (ভাল-মন্দ যাই হোক) যথাযথভাবে ভোগ করতে হবে। এটাই সত্যিকারের ইনসাফ, সত্যিকারের সুবিচার ও সত্যিকারের যথাযথ প্রতিদান যা মহান প্রভু নিশ্চিত করবেন। কিভাবে করবেন তা আপনার-আমার কল্পনার বাহিরে। সুতরাং আসুন আমরা মহান আল্লাহপাকের উপর ১০০% আস্তা রাখি ও তাঁর উপরই নির্ভর করি।
মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ও দ্যর্থহীনভাবে বলেছেন:
“কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।”(সূরা আজ-জিলজাল, আয়াত: ৭-৮)।
“যে সৎকর্ম নিয়ে আসবে সে তদপেক্ষা উত্তম ফল পাবে এবং যে মন্দ কর্ম নিয়ে আসবে এরূপ মন্দকর্মীরা যে যে পরিমাণ মন্দ কর্ম করেছে সে সে পরিমাণেই প্রতিফল পাবে।” (সূরা আল কাসাস, আয়াত: ৮৪)।
“যে সৎকর্ম করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দকর্ম করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক তাঁর বান্দাদের প্রতি কোনো জুলুম করেন না।” (সূরা হা-মিম সিজদা, আয়াত: ৪৬)।
“আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, আজ কারও প্রতি জুলুম করা হবে না। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।” সূরা আল-মুমিন, আয়াত: ১৭)।
“প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী, এটা এ জন্য যে আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।” (সুরা আল আহ্কাফ, আয়াত: ১৯)।
“কেউ যে সৎকর্ম নিয়ে আসবে, সে উৎকৃষ্টতর প্রতিদান পাবে এবং সেদিন গুরুতর অস্থিরতা থেকে নিরাপদ থাকবে। এবং যে মন্দ কাজ নিয়ে আসবে, তাকে অগ্নিতে অধঃমুখে নিক্ষেপ করা হবে। তোমরা যা করছিলে তারই প্রতিফল তোমরা পাবে।” (সূরা আল-নামল, আয়াত: ৮৯-৯০)।
৫. মৃত ব্যক্তিকে গালি দেওয়া নিষেধ
সভ্য ও ভাল মানুষ অন্যকে কখনও গালি দেয় না। অশ্রাব্য বা নোংরা ভাষায় সে কারো সঙ্গে কথা বলে না। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেও নিজে নিয়ন্ত্রিত হয়ে মার্জিত শব্দ ব্যবহার করে। ভদ্র ও সংযতভাবে শোকজ করে। কিন্তু কিছু মানুষ রাগের অতিশয্যে হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অন্যকে অশ্লীল ও শ্রুতিকটূ বাক্যবাণে নাজেহাল করে। গাল-মন্দ করে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করে।
ইসলামে অন্যকে গালি দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। যেকোনো কারণেই হোক, কাউকে গালি দেয়ার অনুমতি নেই। হাসি-কৌতুক ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালি দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অশোভনীয়। মৃত ব্যক্তিদের গালি দিতে প্রিয় নবী (সা:) নিষেধ করেছেন। আয়িশা (রা:) হতে বর্ণিত । তিনি বলেন, নবী (সা:) বলেছেন: “তোমরা মৃতদের গালি দিও না । কারণ, তারা তাদের স্বীয় কর্মফল পর্যন্ত পৌছে গেছে ।” (সহীহ বুখারী: ৬৫১৬)।
তবে উদ্বেগের বিষয় যে ইদানীং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যক্তিরা মারা যাবার পর গালাগালি, বিরূপ মন্তব্য ও সন্তোষ প্রকাশের মাত্রা আশংখাজনক হারে বেড়ে গেছে। এটার কারন কি? কেনইবা এমনটা হচ্ছে? এগুলো নিয়ে উঁচুমানের গবেষনা বা নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। যারা মারা যাচ্ছেন তাদের সমগোত্রীয় বা সমপর্যায়ের জীবিত বা তাদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকাররা একটু সোল-সার্চিং (আত্ম-সমালোচনা) করে দেখতে পারেন।
৬. গালি দেয়া, দোয়া না করা, কর্মের সমালোচনা বা স্বস্তি পাওয়া এক জিনিষ নয়
কেউ মারা গেলে তাকে কোনভাবেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা যাবে না। ইসলাম এটাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা বা না করা সম্পূর্ন আপনার এখতিয়ার। মনে রাখা দরকার আপনার-আমার দোয়ায় পট্ করে কাউকে জান্নাত, জান্নাতুল ফিরদাউস বা জাহান্নাম দিয়ে দেয়া হবে না বা বন্চিতও করা হবে না। প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের ফলাফল (ভাল-মন্দ যাই হোক) যথাযথভাবে ভোগ করতে হবে বলে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় ঘোষনা দিয়েছেন। তবে অন্যের মৃত্যুতে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়া উচিত। এটি অন্যের জন্য কোন দোয়া নয়। বরং এটা ইসলামের সুন্দর আচারিত পদ্ধতি ও নিয়ম যা দ্বারা মহান প্রভু আল্লাহপাকের পরিচয় ও বড়ত্ব প্রকাশ পায়।
এখানে একটা কথা তন্ময় চিত্তে ভাবা দরকার। আপনি একজন প্র্যাকটিসিং মুসলমান। আপনি আপনার বিশ্বাসের সাথে মিল রেখে যথাসম্ভব আমল করে যাচ্ছেন জান্নাতের উচ্চস্থান পাবার নিয়তে ও আশায়। কিন্তু যিনি মারা গেলেন তিনি নামে মুসলমান হলেও জীবদ্দশায় স্রস্টাকে মানতেন না, আখেরাত ও জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাসই করতেন না – আমল তো দুরের কথা। সারা জীবন ইসলাম ও এর পক্ষে যারা ছিলেন তাদের বাঁধা দিয়েছেন শক্তভাবে দু’হাত দিয়ে। ইসলাম বা ইসলামিক কোন ইস্যু শুনলে তাৎক্ষনিক তার রগ খাড়া হয়ে যেত! এমন কোনো শিরক-বিদআত নাই যা তার জীবদ্দশায় তিনি করে যান নাই। এমন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দানের দোয়া করা কি স্ববিরোধী হয়ে গেলো না? এটা তো অনেকটা মৃত ব্যক্তির বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার বাইরে গিয়ে জোর করে তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টার নামান্তর! তাছাড়া এটা আপনার বিশ্বাস ও যে সব জিনিসের উপর ভিত্তি করে আপনার বিশ্বাস তার সাথেও তো বেমানান। আপনি বিশ্বাস করলেন একটি যা আপনি আমল (প্র্যাকটিস) দ্বারা লালন করলেন কিন্তু চাইলেন তার সম্পূর্ন উল্টোটা!
ব্যক্তিকে গালি দেয়া ঠিক না। কিন্তু চিন্হিত বা বড় মাপের জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মানের কোন জালিম বা সীমালঙ্গনকারী যার সিদ্ধান্তে বা হুকুমে বা কর্মকান্ডে হাজার হাজার এমন কি লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্মমভাবে মারা গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন অথবা দায়িত্বপূর্ন পজিশনে থেকে জনগনের শত শত এমন কি হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা দূর্নীতির মাধ্যমে মেরে দিয়েছেন বা বিদেশে পাচার করেছেন এমন ব্যক্তি মারা গেলে তার ক্ষেত্রে কি করা হবে? তাকে গালি দেয়ার দরকার নাই। তবে তার কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা করা দরকার ও ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজন দুটি কারনে। প্রথমত: তার মতো আরও যারা চিন্হিত বা বড় মাপের কোন জালিম বা সীমালঙ্গনকারী আছেন তাদের শিক্ষা, অনুধাবন ও সংশোধনের জন্য। দ্বিতীয়ত: বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জানা ও সতর্কতার জন্য। তাদের কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা না করে যদি শুধু জান্নতুল ফিরদাউসের জন্য দোয়া করা হয়, তাহলে তাদের সমগোত্রীয়দের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তাতে জাতি ও সমগোত্রীয়রা কোনো শিক্ষাতো নিবেই না বা সতর্কতো হবেই না, বরং এগুলো কোন ব্যাপারই নয় মনে করে আস্কারা পাবার সম্ভাবনা বেশী।
এখানে বলে রাখা ভাল মহান আল্লাহপাক তাঁর পবিত্র কোরআনে বড় বড় জালিমদের (যেমন: ফেরআউন, হামান, আবু লাহাব, কারুণ, ছারেমী ও আজর প্রমূখ) নাম উল্লেখ করেছেন, ঘঠনা বর্ননা করেছেন ও ইতিহাস টেনেছেন নিশ্চয়ই আমাদের জানার জন্য, হৃদয়াঙ্গম করার জন্য ও শিক্ষা নেয়ার জন্য। সহিহ হাদিস থেকে প্রমানিত নবী (সা:) ও সাহাবীরা কিছু কিছু জালিমের মৃত্যুতে স্বস্থি প্রকাশ করেছেন। মুসাইলামার মৃত্যুতে আবু বকর (রা:) সিজদাহ দিয়ে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করেন। (সুনান, সাঈদ ইবনে মানসূর)। মুখাদ্দাজ আল খারেজীর মৃত্যুতে খুশি হয়ে আলী (রা:) শুকরানা সিজদাহ দেন। (মুসনাদে আহমাদ)।
সাহাবাদের (রা:) পরবর্তী যুগে একই অবস্থা আমরা লক্ষ্য করি। ইব্রাহিম আন-নাখা’ঈ (রাহ:) হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মৃত্যুসংবাদে সিজদাহ দিয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করেন। (তাবাকাত ইবনে সা’দ: ৬/২৮০)। কুখ্যাত মুতাজিলী মতবাদের সমর্থক আল-মুরাইসী মারা যাওয়ার সংবাদ বাজার করারত অবস্থায় শুনেও বিশর আল হাফি (রাহ:) আনন্দিত হয়ে বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।” (তারীখে বাগদাদ: ৭/৬৬)। সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহ:) তাঁর ‘লিসান আল-মিজাব’ এ একটা ঘটনা উল্লেখ করেন। ওয়াহাব আল-কুরাইশী নামের এক পথভ্রষ্ট মারা গেলে আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ মুসলিমদেরকে ঐ পথভ্রষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।” কুরআনের সৃষ্ট’ এই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা আবু দোয়াদ এর উপর বিপর্যয় আসলে অনেকেই আনন্দিত হোন। একজন ইমাম আহমাদকে (রাহ:) জিজ্ঞেস করলেন, “এরকম আনন্দিত হওয়া কি পাপ?” ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রাহ:) জবাব দিলেন, “এমন কেউ কি আছে, এমন সংবাদ শুনে আনন্দিত হবে না?” (‘আস-সুন্নাহ’, আল-খাল্লাল)। একজন বিদ’আতী গুরু মারা গেলে আল্লামা ইবনে কাসির (রাহ:) তাঁর বিখ্যাত ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ বইয়ে সেই ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে, “আল্লাহ মুসলিমদেরকে সেই পথভ্রষ্টের গোমরাহি থেকে রেহাই দিয়েছেন”।
তাছাড়া সহিহ বোখারীর হাদিস (হাদীস নং: ৬১৪৭) থেকে জানা গেল যে নবী (সা:) বলেছেন “যখন জালিম মারা যায় তার কবল সকল মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই (পরিত্রাণ পেয়ে) “স্বস্তি” বোধ করে।” মানুষের প্রশংসা ও দুর্নামের ভিত্তিতেও জান্নাত ও জাহান্নাম অবধারিত হতে পারে। আনাস (রা:) বলেন, কিছু লোক একটা মৃতদেহ নিয়ে পার হয়ে গেল। লোকেরা তার প্রশংসা করতে লাগল। নবী (সা:) বললেন, “অবধারিত হয়ে গেল”। অতঃপর দ্বিতীয় আর একটি মৃতদেহ নিয়ে পার হলে লোকেরা তার দুর্নাম করতে লাগল। নবী (সা:) বললেন, “অবধারিত হয়ে গেল।’’ উমার ইবনে খাত্ত্বাব (রা:) বললেন, কী অবধারিত হয়ে গেল?’ তিনি বললেন, তোমরা যার প্রশংসা করলে তার জন্য জান্নাত, আর যার দুর্নাম করলে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেল। তোমরা হলে পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।’’ (বুখারি: ১৩৬৭, ২৬৪২, মুসলিম: ৯৪৯)।
দীর্ঘ প্রমান ও দলিলভিত্তিক আলোচনার পর উপসংহার টানবো আমরা এই বলে যে কারো মৃত্যুতে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়া উচিত। এটা ইসলামের সুন্দর আচারিত নিয়ম। পারলে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করুন – তার জন্য ক্ষমা/মাগফিরাত চান। যদি দোয়া করতে নাই পারেন, অন্তত: নীরব থাকুন। মৃত ব্যক্তিকে কখনও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করবেন না। তবে হ্যাঁ, ব্যক্তিকে গালি দেয়া আর ব্যক্তির কৃত কর্মের আলোচনা বা সমালোচনা করা এক জিনিষ নয়। উপরের হাদিস ও দলিলের আলোকে কুখ্যাত জালিমদের বা সীমালঙ্গনকারীদের মৃত্যুতে স্বস্তি প্রকাশ অন্যায় নয়। আর এই স্বস্তি প্রকাশ বলে কয়ে আসে না। এটা এমনিতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশ পায়।
লেখক: বৃটেনের স্বনামধন্য আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গবেষক ও বিশ্লেষক।