বিএনপি-জামায়াত নের্তৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কয়েক দফা টানা অবরোধের পর এবার শুরু হলো সরকারি অবরোধ। আর এই অবরোধে রাজধানী ঢাকার সাথে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা ও বিভাগীয় শহরের যোগাযোগ কার্যত: বন্ধ হয়ে গেছে।
১৮-দলীয় জোটের ঢাকা অভিমুখে ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কাল ২৯ ডিসেম্বর। এই কর্মসূচি ঠেকাতেই মূলত: সরকারের অঘোষিত ‘অবরোধ’ শুরু হয়ে গেছে। আজ শনিবার রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে জানা গেছে মাত্র ৫ শতাংশ দূর পাল্লার বাস ছেড়ে এসে টার্মিনাল গুলোতে পৌঁছেছে।
শনিবার দুপুর ১২টার পর রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে আর কোনো দূরপাল্লার বাস প্রবেশ করতে দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ও সরকারি দলের চাপের কারণেই বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা অভিমুখে সড়ক, নৌ ও রেল চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে নাম প্রকাশ না করে জানানো হচ্ছে, সরকারী দলের চাপের কারণে বন্ধ রাখা হচ্ছে এসব পরিবহন। কৌশলে ট্রেন চলাচলও কার্যত: বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সরকারি অবরোধ বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে পুলিশ, সরকারি দলের নেতা-কর্মী এবং সরকার-সমর্থক বাস ও লঞ্চের মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তবে তারা বাঁধা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
বাস কাউন্টারগুলো থেকে টিকিট সংকট দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। ২৯ ডিসেম্বরের ঢাকা অভিমুখে যাত্রার দুদিন আগেই সরকার যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পরিবহন কোম্পানির মালিকেরা জানিয়েছেন, ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দূর পাল্লার পথে বাস চালালে নাশকতার আশঙ্কা আছে এবং নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। একই কথা বলে দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সরকার-সমর্থক মালিক-শ্রমিক নেতারা।
এজন্য মূলত: গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বাস বন্ধ হয়ে গেছে। অল্প যেসব স্থান থেকে বাস চলছে, সেগুলো আজ শনিবার পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
নৌপথে ও সরকার-সমর্থক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশে লঞ্চ, স্টিমার ও ট্রাক বন্ধ রয়েছে। অনেক স্থানে ফেরি চলাচলও বন্ধ এবং কিছু স্থানে সীমিত করা হয়েছে।
রেলপথে ঢাকামুখী যাত্রী ঠেকাতে টিকিট নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে গত শুক্রবার সকালে কয়েকটি ট্রেন ঢাকা ছেড়ে আসলেও দুপুর থেকে সব ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
তবে এব্যাপারে রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের জানান, ১৮ দলের সমাবেশ উপলক্ষে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়নি।
যেসব ট্রেন আসেনি তা সংশ্লিষ্ট রেল স্টেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ট্রেন ছেড়ে দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপের কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার থেকে যেসব যানবাহন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে, সেগুলোর যাত্রীরাও পথে পথে তল্লাশির শিকার হন।কাউকে কাউকে যাত্রা পথে নামিয়ে দেয়া হয়। অনেককে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, জন-নিরাপত্তার স্বার্থে বিরোধী জোটের নয়াপল্টনে সমবেত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
তবে গতরাতে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া একভিডিও বার্তায় দেশবাসী ও নেতা-কর্মীদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিরোধী দলের টানা অবরোধ কর্মসূচির সময় যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দফায় দফায় বৈঠক করে বাস ও নৌ পথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার জন্য বাস ও লঞ্চ মালিকদের অনুরোধ করতে দেখা গেছে। এখন সরকারের পক্ষ থেকেই বাস চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে।
সরকারের এমন বার্তার পর শুক্রবার বিকেল থেকেই অনেক জেলা থেকে ঢাকামুখী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জেলা-উপজেলায় ১৮-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা যাতে বাস ভাড়া করতে না পারেন, সেজন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি জেলায় মাইকিং করে বাস বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন সরকার-সমর্থক পরিবহন নেতারা।
রাজধানীর কল্যানপুর পরিবহন খাতের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার বিকেলে মিরপুরে সাংসদ আসলামুল হকের ভাই মফিজুল হকের বাসায় পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের ডেকে বৈঠকে বসেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। সেখানে আসলামুল হকও ছিলেন। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের উপস্থিতিতে এবৈঠক থেকে বাস নাচালানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
পরিবহন খাতের সরকার-সমর্থক একাধিক নেতা জানান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ কার্যালয়েও পরিবহন নেতাদের ডেকে নিয়ে একই ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সূত্রজানায়, সরকারের অঘোষিত অবরোধ বাস্তবায়নের কাজে সমন্বয় করছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহা-সচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ,বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রমুখ।
অন্যদিকে, গণ-পরিবহন খাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় মটর চালক লীগ’ আজ শনিবার থেকে ৩৬ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে।
ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রল পাম্প ও সিএনজি স্টেশনগুলো বন্ধ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। পাম্প মালিকদের পক্ষ জানানো হয়েছে,যান বাহনে জ্বালানি সরবরাহ নাকরতে বলা হয়েছে সরকারি লোকজন নিষেধ করছেন। তবে পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হক তা অস্বীকার করেন।
রাজধানীর মহাখালী টার্মিনাল সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে কিছু বাস আসলেও শুক্রবার বিকেল থেকেই নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন পথের বাস চালানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আজ শনিবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই একটি গাড়ী ছাড়া কোনো দূর পাল্লার বাস ছেড়ে আসে নি।
শাহ ফতেহ আলী নামে একটি বাস বিকেল তিনটায় বগুড়া থেকে ছেড়ে আসার পর শুক্রবার বগুড়া থেকে আর কোনো বাস ছেড়ে আসেনি বলে জানান ওই বাসের যাত্রী আবু রেজওয়ান।
অন্য দিকে বাস চলাচল রাজশাহী থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিকেল পাঁচটায়। রংপুরে বিকেলে বাস চলাচল বন্ধ হওয়ার কথা মাইকে ঘোষণা করা হয়। পটুয়াখালী ও চুয়াডাঙ্গা থেকে বাস বন্ধ হয়ে যায় সকাল ১০টায়। দুপুর থেকে বাস চলেনি বরিশাল থেকেও।
বগুড়ায় বিভিন্ন বাস কোম্পানির ২০-২৫টি কাউন্টার আছে। ঢাকা-বগুড়া পথের এস আর পরিবহনের বগুড়ার ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বলেন,‘বাস ও যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কল্যাণপুরে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের সামনে কয়েকজন যাত্রী জানান, শনিবার জয়পুরহাট যাওয়ার জন্য টিকিট কেটেছেন। তবে বাস চলবে কিনা, কাউন্টার থেকে বলতে পারেনি। ফোন নম্বর রেখে দিয়ে বলেছে, বাস না চললে টিকিট ফেরত নেওয়া হবে।
রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, ১৮দলের কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধ করার ঘোষণা শোনার পর থেকে তাঁরা গাড়ি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একটি পরিবহন কোম্পানির মালিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ফাটা বাঁশে আমাদের পা আটকে গেছে। আমরা এখন কই যাব। বাস চালালেও দোষ না চালালেও দোষ।’
সম্প্রতি নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের কথামতো অবরোধে বাস না চালিয়ে ভর্ৎসনার শিকার হন অনেকে। এবার বাস না চালানোর জন্য তিনি কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান ওই পরিবহন মালিক।
গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টার্মিনাল থেকে বের হলেই পুলিশ গাড়ি রিকুইজিশন করছে। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বাস চালাতে নিষেধ করেছে। তাই শুক্রবার সন্ধ্যার পর সব বাস বন্ধ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ টাইম নিউজকে বলেন, আমরা কোনো পরিবহন মালিককে বাস বন্ধ রাখতে বলিনি। নিরাপত্তার কথা ভেবে যদি কেউ বাস নাচালায়, সে অজুহাত তো আমি দিতে পারি না।