বাবা রিকশা চালাতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। দুজনের কারোরই তেমন অক্ষরজ্ঞান ছিল না, কিন্তু তাঁদের সব সময় স্বপ্ন ছিল তিন ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড় করবেন। ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মো. আকাশ হোসেন। পরীক্ষা দিয়েছিলেন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়েছিলেন আকাশ। ভর্তি হন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে। বুয়েটে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামের একটি দাতব্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বৃত্তির টাকা আর টিউশনি করে পড়াশোনা করছিলেন। স্বপ্ন ছিল একটাই। ছোট দুই ভাইবোনকেও ঠিকমতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। মা-বাবার কষ্ট দূর করে তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবেন।
২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয় ‘নিজেরে করো জয়’ শিরোনামে ছাপা হওয়া গল্পে এমনই কথা লিখেছিলেন মো. আকাশ হোসেন। সেই আকাশ (২১) এখন বুয়েটের আরেক মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বী হত্যা মামলার ১৩ নম্বর আসামি। গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার সময় ও পরে লাশ রুম থেকে সরিয়ে সিঁড়িতে নেওয়ার সময় সিসিটিভির ফুটেজে আকাশকে দেখা গেছে।
মামলার এজাহারে আকাশের ঠিকানা ও মা-বাবার নাম অজ্ঞাত লেখা আছে। তিনি বুয়েটের পুরকৌশল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচ বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১০০৮ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাজীপুর বাইপাস সড়ক থেকে আকাশকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের দিন বুধবার তাঁকে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় ডিবি পুলিশ। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত আকাশের লেখা সূত্রে জানা গেছে, জয়পুরহাট সদর উপজেলার দোগাছী গ্রামে আকাশের বেড়ে ওঠা। গ্রামটির একাংশে ২০১৬ সাল পর্যন্তও বিদ্যুৎ ছিল না। ছোটবেলা থেকে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশোনা করেছেন আকাশ। বেশি রাত পর্যন্ত জেগে পড়তে পারেননি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার উপার্জন আর স্কুল থেকে পাওয়া উপবৃত্তির টাকায় পড়েছেন। স্কুলে থাকতে কখনো কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কলেজে থাকার সময় শিক্ষকরা বিনা পয়সায় তাঁকে পড়াতেন।
দোগাছী উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসি ও জয়পুরহাট সরকারি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার পর মা-বাবার স্বপ্নটা আরো উজ্জ্বল হয়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তাঁর প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে হয়। বাবা আতিকুল ইসলাম তাঁর সঞ্চয়ের সব টাকা দিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেন রাজশাহীতে। যেন সব ভুলে মন দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন। পরীক্ষা দেন বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব প্রতিষ্ঠানেই চান্স পান। ভর্তি হন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে।
সেই আকাশের বাবা আতিকুল ইসলামের স্বপ্ন এখন ভেঙে চুরমার। বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আকাশ বুয়েটে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এটা জানতাম না। ওকে রাজনীতিতে না জড়াতে বারবার নিষেধ করেছিলাম। সে যদি আমার কথা শুনত তাহলে আজ এ পরিস্থিতি হতো না।
আতিকুল ইসলাম বলেন, তিনি পেশায় ভ্যানচালক। তাঁর একার রোজগারে চলে সংসার। অনেক আশা নিয়ে ছেলে আকাশকে বুয়েটে ভর্তি করিয়েছিলেন। আশায় ছিলেন অভাবের সংসারে এক সময় পূর্ণতা আনবে আকাশ। সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সংসারের হাল ধরবে।
আতিকুল জানান, সন্তান আকাশকে মানুষ করার স্বপ্নে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন তিনি। এখন এই ঘটনায় স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন শেষ। এখন স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, জীবনটাই বাঁচানো দায় হয়ে পড়ছে। পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায়। চোখে মুখে সব ঝাঁপসা দেখতেছি।’
আকাশের বাবা বলেন, ‘ছেলেকে বুয়েটে পাঠাই ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। নিজে না খেয়ে তার জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠাইছি আজ এই দিন দেখার জন্য? পুরো জয়পুরহাট জেলার লোক আকাশের সুনাম করছিল। মেট্রিক-ইন্টারে গোল্ডেন এ প্লাস পাইছে। এলাকার মানুষ তার লেখাপড়ায় নিজ থেকে সহযোগিতা করেছে। আজ সব শেষ হয়ে গেল।’