সারাদেশে গত নয় মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩০৯ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৮৪ জন, পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৪২ জন, গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২২ জন, যৌথবাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন, কোস্টগার্ডের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন, বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪১ জন, পুলিশের নির্যাতনের ছয় জন, পুলিশের গুলিতে তিন জন, বিজিবির গুলিতে তিন জন এবং পুলিশ হেফাজতে আত্মহত্যা করেছে দুই জন।
এছাড়া, দুই জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয় এবং হেফাজতে অসুস্থ হয়ে মারা যান একজন।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ অনুযায়ী, সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ১২ জনকে আটক করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে চার জন ফেরত এসেছেন এবং একজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আটকের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কারা হেফাজতে মৃত্যু: গত নয় মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৪৮ জন। এরমধ্যে কয়েদি ১৮ জন এবং হাজতি ৩০ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র
গণপিটুনিতে নিহত: গত ৯ মাসের মধ্যে জুলাই-আগস্টের দিকে ছেলেধরা গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যায়। গত নয় মাসে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন ৬০ জন। এর মধ্যে শুধু জুলাই মাসেই মারা যান ১৭ জন।
রাজনৈতিক সংঘাত: নয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৬০টি। এসব সংঘাতের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৪ জন এবং আহত হয়েছেন ১৮৬৭ জন।
নারী নির্যাতন: গত নয় মাসে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এসময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২০৩ জন নারী। যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। এসব ঘটনায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে খুন হয়েছেন চার জন নারী ও ছয় জন পুরুষ। হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ১৯৬ জন নারী-পুরুষ।
ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১১৫ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৭ জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন নারী। এছাড়া, ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১৭৮ নারীকে।
পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৯৭ নারী। এরমধ্যে ২১৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪২ জন নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১২১ নারী। হেল মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৪ জন। নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৭০ জনকে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনজন নারী। এছাড়া, স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছেন চার জন নারী।
২৯ জন গৃহকর্মীকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১২ জন নারী।
শিশু নির্যাতন ও হত্যা: দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের হত্যা এবং নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। গত নয় মাসে এক হাজার ৪৪ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১৮২ শিশু। আত্মহত্যা করেছে ৬০ শিশু। বিভিন্ন সময়ে ৩৮ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ৫২ শিশুর।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন: হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪০টি প্রতিমা ভাঙচুর মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৭ জন। এছাড়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ষোলটি বসতঘর ও দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৫০ জন।
সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি: গত নয় মাসে ৮৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়া, একজন সাংবাদিকের রহস্যজনক মৃত্যু ও এক সাংবাদিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সীমান্ত সংঘাত: সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতন ও গুলিতে নিহত হয়েছেন ২৯ জন। এর মধ্যে ২৫ জন গুলিতে এবং শারীরিক নির্যাতনের চার জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া, আহত হয়েছেন ৩২ জন ও অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৫ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে সারাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, আটক, রহস্যজনক নিখোঁজ, গণপিটুনিতে হত্যা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, সীমান্তে নির্যাতন ও হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।