অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে দেশে গঠিত হতে যাচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সংবিধান অনুযায়ী নতুন এই সরকার নির্বাচন পরিচালনা ও নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব পালন করবে। বিধি মোতাবেক গেল জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকারের মতোই এবারও নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে থাকছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সরকারের পরিধি খুব ছোট হবে, তাই নতুন সরকারে মন্ত্রী হিসেবে দেখা যাবে না বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা বেশিরভাগ মন্ত্রীকে।
ফলে বর্তমান মন্ত্রীদের হাতে নেওয়া নানা প্রকল্পের কাজ শেষ করা জরুরি বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এজন্য প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন সেক্টরে আগের তুলনায় বেড়েছে কাজের চাপ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে উন্নয়নমূলক কাজের গতি বাড়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেড়েছে ব্যস্ততা। তারা বলছেন, সরকারের শেষ সময়ে আমাদের কাজগুলো রুটিন মাফিক চললেও কাজে শেষ সময়ে বেড়েছে চাপ। এছাড়া তৃণমূলের কাজের গতি-প্রকৃতি যাচাই-বাছাইয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
এদিকে, সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণায়ের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে বড় কর্তা-ব্যক্তিদের ওপর আছে অতিরিক্ত চাপও। এমনকি এজন্য গেল ছয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ বদলি ও পদোন্নতির ঘটনাও ঘটেছে।
গেল ছয় মাসে র্যাব ও পুলিশের ৪ কর্মকর্তাসহ সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে প্রায় ২৫ জনকে। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন দেড় শতাধিক যুগ্ম সচিব, যুগ্ম সচিব করা হয়েছে দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে এবং নতুন করে শুধু গেল মাসের শেষ সপ্তাহেই ২০ জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও নির্বাচনকালীন সময়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন ও সরকারের শেষ সময়ে প্রশাসনের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করতে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) মাহমুদা শারমীন বেনু পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমাদের সরকারি দফতরগুলোতে সকল কাজ ডিজিটাল সিস্টেমে হওয়ায় রুট পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কাজের পর্যালোচনা বেড়েছে। এর সাথে কাজে গতি বাড়লে প্রকল্পের পরিমাণ বাড়ার কারণে কিছুকিছু কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, আমরা সাধারণত যে কাজগুলো করি তা এনজিওভিত্তিক। দেশ এখন ডিজিটাল হয়েছে। আমাদের কাজের মাত্রাও বেড়ে গেছে। আমরা প্রতিদিনই তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন কাজ মনিটরিং করছি। প্রায় প্রতিদিনই মিটিং করতে হয়।
সরকারের শেষ সময়ে কাজের চাপের বিষয়ে মাহমুদা শারমীন বলেন, আসলে আমাদের কাজগুলো সবই রুটিন মাফিক। তবে আমাদের প্রকল্পের কাজগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে চাপ তো থাকছেই।
বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, যেসব উন্নয়নমূলক কাজ চলতি বছরের মধ্যেই শেষ হবার কথা, সেগুলো জোর দিয়ে চলছে। তবে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ বাজেট বৃদ্ধি ও রেয়াদ বাড়ানোয় সেই কাজগুলো এখনো চলছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ (বেসরকারি মাধ্যমিক) পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজ খুব পেইনফুল। সারাদিন প্রায় শতাধিক লোকের সঙ্গে এমপিওভুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে হয়। আবার অনেকে সরকারের শেষ সময়ে আসছেন তদবির করতে।
নির্বাচনের আগে তদবিরের চাপ বেড়ে গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন, উনারা (মন্ত্রী ও এমপি) তো জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বিষয়ই তাদের দেখতে হয়। আর সেই বিষয়গুলো তো প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের সমাধান করতে হয়।
এছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও প্রশাসনিক লোকদের পদোন্নতির বিষয়ে বেড়েছে আনাগোনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঠ প্রশাসন অধিশাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, আগের তুলনায় এখন পদোন্নতি চাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। সবার ধারণা সরকারের শেষ সময়ে পচ্ছন্দের জায়গা না পেলে নতুন সরকার এসে আবার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হতে হতে অনেক পিছিয়ে যাবে। অথবা পছন্দের জায়গায় যাওয়াটা আদৌ নাও হতে পারে।
এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ভালো জায়গায় বদলি হতে তোড়জোর। সম্প্রতি জুনিয়র কনসালটেন্ট থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য চাওয়া হয়েছে আবেদন। এর জন্য বলতে গেলে এ মন্ত্রণালয়টিতে সংশ্লিষ্টরা অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সরকারের শেষ মেয়াদে এ পদোন্নতি দিয়েই যাবে বর্তমান সরকার। এ বিষয়ে অধিশাখার কর্মকর্তা মোহাম্মাদ জাফর বলেন, এটা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে প্রথম দফা মিটিং হয়েছে। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) রুপন কান্তি শীল পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, সরকারি কাজ নিজস্ব গতি অনুযায়ী চলে। তবে অনেক প্রকল্পভিত্তিক কাজের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সংশ্লিষ্ট কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। এজন্য অনেক সময় বছর শেষে কাজের ভিড় বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছরের শুরুতে সরকারের সঙ্গে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, পরিদফতর ও অধীনস্থ দফতরগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি এমওইউ চুক্তি হয়। এ চুক্তি অনুসারে বছরজুড়ে গৃহীত পরিকল্পনার কাজ বুঝে দিতে হয়। সেই অনুসারে শেষ সময়ে এসে সংশ্লিষ্ট কাজ শেষ করতে দফতরগুলোতে কাজের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়াও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া প্রতিশ্রুত কাজ সমাধা করতেও সরকারি কর্মকর্তাদের সময় দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে কাজ তো বেড়েছেই।