*এরশাদের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না সরকার
*এরশাদ শেষ সময়ে উল্টে যান কি না, এই আশঙ্কা রয়েছে
*নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার জন্য এরশাদ ও রওশনের পৃথক তালিকা
*রওশনকে সরকারের বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় বিষয়টি আলোচিত
*বিভক্তি তৈরি করে জাপাকে কবজায় রাখতে চায় সরকার
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এইচ এম এরশাদ ও তাঁর দল জাতীয় পার্টিকে (জাপা) সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সরকার। এ জন্য দলের দুই শীর্ষ নেতা এরশাদ ও তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব এবং দলে বিভক্তি সৃষ্টির তৎপরতা চলছে বলে জাপার উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
জাপা সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অভিজ্ঞতায় এরশাদের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না সরকার। এরশাদ শেষ সময়ে উল্টে যান কি না, সরকারি দলের তরফে এই আশঙ্কা রয়েছে। তাই আগেই বিভক্তি তৈরি করে জাপাকে নিয়ন্ত্রণের চাবি সরকার নিজের কবজায় রাখতে চায়।
জাপা থেকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় রাখার জন্য সরকারপ্রধানের কাছে সম্প্রতি এরশাদ ও রওশন পৃথক তালিকা দেওয়ার পর দুজনের মধ্যে নতুন করে দূরত্ব দেখা দেয়। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে রওশনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় বিষয়টি জাপার ভেতরেও আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে।
জাপার উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করছেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের কর্তৃত্ব নিয়ে এরশাদ ও রওশনের মধ্যে পুরোনো বিভক্তি নতুন করে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে মূলত দুটি কারণে। এক. এরশাদের ওপর সরকারের শীর্ষ মহলের আস্থার সংকট রয়েছে। তাই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো এবারও এরশাদ যদি হঠাৎ ভিন্ন কোনো অবস্থান নেন, তা রওশনকে দিয়ে সামলানো। দুই. আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে এরশাদ যাতে বেশি দর-কষাকষি করতে না পারেন।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার যার দল তারা করবে, আমরা কেন তাদের দলে বিভক্তি চাইব। রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, এরশাদ সাহেব প্রধানমন্ত্রীর দূত হয়েছেন। তাঁরা আমাদের সঙ্গে আছেন, নির্বাচন করবেন, আমাদের সমর্থন দেবেন।’
জাপার সূত্রগুলো বলছে, দলের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিয়ে সম্ভাব্য প্রতিকূল অবস্থার কথা আঁচ করতে পেরেছেন এরশাদ। তাই তিনি গতকাল রোববার দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদদের নিয়ে যৌথ সভা ডেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়াসহ নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছেন, যাতে রওশন বা অন্য কেউ তাঁর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ না পান।
গতকাল সকালে জাপার চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে এই সভা হয়। এরশাদের সভাপতিত্বে সভায় সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ দলের সভাপতিমণ্ডলী সদস্য ও সাংসদ মিলেয়ে ৫৬ জন উপস্থিত ছিলেন। সভায় আগামী ২০ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়।
পরে জাপার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, যৌথ সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-সম্পর্কিত সব ক্ষেত্রে পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক দায়িত্ব চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে না জোটগতভাবে নির্বাচন করবে, সে ব্যাপারে চেয়ারম্যানই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এ ছাড়া দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হবে।’
যদিও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২১ নম্বর ধারায় ‘পার্লামেন্টারি বোর্ড’ গঠনের বিষয়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী মনোনীত করতে সাত সদস্যের একটি পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠিত হবে। এই পার্লামেন্টারি বোর্ড তৃণমূলের সুপারিশকৃত প্যানেলের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে উল্লেখ রয়েছে।
এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর এরশাদ দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারসহ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠক করেন। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। ওই বৈঠক শেষে জাপার সাংসদ ফখরুল ইমাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও রওশন এরশাদ একান্ত বৈঠকে আগামী নির্বাচনে জাপার আসনসংখ্যা, নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এরশাদ নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য রুহুল আমিন হাওলাদারসহ জাপার তিনজন নেতার নাম দেন। আর রওশন এরশাদ দলীয় সাংসদ ফখরুল ইমামসহ অন্য তিন নেতার পৃথক তালিকা দেন।
এই পৃথক তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফখরুল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালিকার বিষয়ে ম্যাডাম (রওশন) বলতে পারেন। আমি নিজের চোখে দেখিনি। আবার স্যারেরটাও (এরশাদ) দেখিনি। এটা একটা নিউজ। তবে অথেনটিক (সঠিক) নিউজ কি না, নিশ্চিত করতে পারব না।’
এর আগে দলীয় প্রধান এরশাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই রওশন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে নুরুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করেন। নুরুল ইসলাম গত ১৮ সেপ্টেম্বর চিফ হুইপের দায়িত্ব পান। এ নিয়েও দলে কথা উঠেছে।
জাপার উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে সরকারের পক্ষ থেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচন নিয়ে এরশাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। ওই সময় এরশাদ জাপা নিয়ে সরকারের ভূমিকায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সরকারকে আগে ঠিক করতে হবে, তারা এরশাদ নাকি রওশনের সঙ্গে আলোচনা করবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতা জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এরশাদের যে বৈঠক হয়, তাতে রওশনের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রসঙ্গটি এমনভাবে উত্থাপিত হয় যে এ নিয়ে জাপার নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। ওই বৈঠকের পরদিনই জাপার মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে দুর্নীতি দমন কমিশন নোটিশ পাঠায়। এ নিয়ে দলে সন্দেহ তৈরি হয়। জানা গেছে, দলের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নামেও দুদকের চিঠি প্রস্তুত রয়েছে। ওই নেতা বিগত সময়ে জাতীয় সংসদে সরকারের আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা বিষয়ে সমালোচনায় মুখর ছিলেন।
জানতে চাইলে জাপার কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের দাবি করেন, দলে কোনো বিভক্তি নেই। রওশন এরশাদও গতকালের সভায় বলেছেন, উনি কখনোই দলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি, ভবিষ্যতেও নেবেন না। যাঁরা দলের বিভক্তির গুজব ছড়াচ্ছেন, তাঁরা দলের মঙ্গল চান না।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেষ মুহূর্তে বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন এরশাদ। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁকে বাসা থেকে নিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করান। এরপর রওশন এরশাদ জাপার বড় একটি অংশকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয়। ওই নির্বাচনে জাপা ৩৪টি আসন পায়, রওশনও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন। এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেও সাংসদ হন, পরে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন। এরপর জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ পরোক্ষভাবে সরকারের হাতে চলে যায়। দলের কর্তৃত্ব নিয়ে রওশন ও এরশাদ দুই মেরুতে অবস্থান নেন। পরে একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে একধরনের সমঝোতা হয়। এখন আবার পুরোনো বিভেদ জাগানোর ক্ষেত্রে সরকারের হাত রয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, দলে এবারের মেরুকরণ ভিন্ন। কারণ, গতবার রওশনের পক্ষ নিয়ে যাঁরা নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, এবার তাঁদের বেশির ভাগই রওশনের সঙ্গে নেই। গতবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। এবার তাঁরা এরশাদের সঙ্গেই আছেন।