ব্রেকিং নিউজ
Home / বাংলাদেশ / বাংলাদেশি তাকিয়ানের এমআইটি জয়, ম্যাটারিয়ালস সায়েন্স গবেষণায় বিস্ময়কর অর্জন

বাংলাদেশি তাকিয়ানের এমআইটি জয়, ম্যাটারিয়ালস সায়েন্স গবেষণায় বিস্ময়কর অর্জন

তাকিয়ান ফখরুল যখন একজন তরুণী মেয়ে ছিলেন তার পিতা যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের একজন ছাত্র হিসেবে তাকিয়ানকে তার সাথে বিজ্ঞান ল্যাবে নিয়ে যেতেন। কৌতূহলী তাকিয়ান তার বাবার সাথে বিজ্ঞান ল্যাবে গিয়ে প্রায়শই অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তু দেখতে চাইতেন। বিজ্ঞান ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী তাকিয়ান কখনো সেখানে একেবারে নীরব থাকতেন না।

তাকিয়ান এখন এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ম্যাটারিয়াল সাইন্সে’ পিএইচডি গবেষণার চতুর্থ বর্ষের একজন ছাত্রী। তিনি বলেন- ‘আমি আমার বাবাকে অনেক বেশী প্রশ্ন করতাম’, আর আমার বাবা বলতেন- ‘আমি ছিলাম খুবই কৌতূহলী একজন বালিকা।’

তাকিয়ানের ছোট বেলার এই কৌতূহল আরো বেশী অদম্য হয়ে যায় যখন তিনি তার মাতৃভূমি বাংলাদেশের বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের(বুয়েট)’ একজন ছাত্রী ছিলেন। তার বাবা যিনি বুয়েটের মেটেরিয়াল সাইন্স বিষয়ের একজন অধ্যাপক, তিনি তার মেয়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে মেটেরিয়াল সাইন্স বিষয়ে অধ্যয়ন করতে উৎসাহ যোগান।

তাকিয়ান জানান, তিনি এবং তার বাবা প্রায় সময় বিভিন্ন মেটেরিয়াল (বস্তু) নিয়া আলাপ-আলোচনা করেন এবং কিভাবে ‘বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে প্রভাব পেলতে পারে সে ব্যাপারে গবেষণা করেন।’

তাকিয়ান বর্তমানে ক্যারোলিন রোজ নামের একজন অধ্যাপকের সাথে গবেষণারত আছেন। আলোর তড়িৎ প্রবাহে গারনেটস (garnets একধরনের গোলাপি স্ফটিক কিউব আকৃতির বস্তু) ব্যবহারের সমস্যাকে কিভাবে ফোটোনিকস (photonics) ব্যবহার করে দূর করা যায় তাই তাকিয়ানের গবেষণার বিষয়বস্তু।

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তাকিয়ান তার মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসতে চান এবং এখানকার শিক্ষার্থীদেরকে ম্যাটারিয়াল বিজ্ঞানে শিক্ষা দিতে চান। তিনি ম্যাটারিয়াল বিজ্ঞান বিষয়ে তার মাতৃভূমিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।

তাকিয়ান এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এখানে যে অভিজ্ঞতা নিয়েছি তা আমার মাতৃভূমিতে নিয়ে যেতে চাই এবং আশা করি আমি এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের সাথে একটা সেতুবন্ধন তৈরী করতে পারবো।’

গতির সীমা ভেঙ্গে দেয়া:

কম্পিউটারের ভিতরে কপারের তৈরী তারের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য কম্পিউটার চিপে এবং এর অন্যান্য অংশে চলাচল করে থাকে। তাকিয়ান বলেন, তবে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে ‘কম্পিউটারকে আরো বেশী দ্রুত গতির হতে হবে।’

এটি করতে হলে বিজ্ঞানীদের কে এমন কিছু বিষয় ডিজাইন করতে হবে যার মাধ্যমে তথ্য আরো বেশী দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পারবে এবং একই সাথে কম বিদ্যুৎ খরচ করবে।

তাকিয়ান বলেন, ‘সমস্যা হলো, ইলেকট্রন যখন বস্তুগত তারের মাধ্যমে চলাচল করে তখন এর গতি অনেকটাই ধীর হয়ে যায়।’, ‘তাহলে বস্তুগত তারের চাইতে ইলেকট্রনকে কিসে দ্রুত গতিতে চলাচল করতে সহায়তা করবে? এর উত্তর হলো আলোক শক্তি।’

সাধারণ তারের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক তথ্য একটি মাত্র পথে চলাচল করতে সক্ষম আর অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে এটি বিভিন্ন মাধ্যমে চলাচল করতে পারে সুতরাং কোনো প্রকার বাঁধা-বিপত্তি ছাড়াই ব্যান্ডউইথ তার যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারবে।

বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং প্রকল্পে ইতিমধ্যেই অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যবহার বেড়েছে আর এখন সময় হয়েছে কম্পিউটারের ভেতরকার তথ্য আদান প্রদানের জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করার।

তাকিয়ানের গবেষণার বিষয়বস্তু হচ্ছে অপটিক্যাল আইসোলেটরস(অন্তরক) নিয়ে। এটি লেজার ব্যবহৃত একটি সিলিকন ফোটোনিকস যা যার মধ্যমে আলো একমুখী পথ দিয়ে চলাচল করতে সক্ষম।

তকিয়ান বলেন, ‘এটি আলোকে সামনের দিকে চলতে বাধ্য করবে কিন্তু উল্টো দিকে ফিরে আসতে বাধা দিবে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি আরো বলেন, ‘লেজারের ভেতরে উল্টোদিকে ফিরে আসা মানে একে অস্থিতিশীল করে দেয়া এবং এর কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করে দেয়া।’

এজন্য তাকিয়ান আয়রন গারনেটের ব্যবহার করতে চান, যা একটি রাসায়নিক বিকল্প যেটি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের বস্তু তৈরী করতে সক্ষম হন। স্ফটিক প্রকৃতি গারনেট আলোকে সঠিক ভাবেই কোনো বাঁধা ছাড়া সামনে চলতে বাধ্য করতে পারে।

তাকিয়ান বলেন, ‘আলো যখন গারনেটের ভেতর দিয়ে চলাচল করে এটি তখন ভিন্ন ভিন্ন পথে চলাচল না করে একমুখী হয়ে চলাচল করে।’

তিনি গারনেটের ব্যাবহারের মাধ্যমে আলোর একমুখী চলাচল নিশ্চিত করতে চান তবে এটি অতোটা সহজ কোনো বিষয় নয়।

সমাজকে কিছু উপহার দেয়া:

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর তাকিয়ান সেখানে ম্যাটারিয়াল বিজ্ঞানের একজন প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং একই সাথে তিনি বুয়েট থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নের সময় তিনি তার সহকর্মী নাদিম চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নাদিম চৌধুরী সে সময় বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তাকিয়ান বলেন, ‘বিয়ের এক মাসের মধ্যেই আমি এমআইটি থেকে নির্বাচিত হওয়ার চিঠি পাই এবং নাদিম প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হন। আমরা সে সময় এত দূরত্ব থাকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু নাদিম এক সপ্তাহ পরেই এমআইটি থেকে নির্বাচিত হওয়ার চিঠি পেয়ে যায়। তখন এ বিষয়টি আমার কাছে অনেকটা অলৌকিক ব্যাপার মনে হয়েছিল।’

তাকিয়ান তার স্বামীর সাথে ক্যামব্রিজে চলে যান এবং এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অধ্যয়ন শুরু করেন। বাংলাদেশীদের সাথে যুক্ত থাকার জন্য তাকিয়ান এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের সাথে যোগ দেন। এমনকি তিনি এসোসিয়েশনটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

গবেষণায় উন্নতি করা:

তাকিয়ান শেষ পর্যন্ত তার মাতৃভূমি বাংলাদেশের ঢাকা শহরে ফিরে আসতে চান এবং সেখানে তিনি ম্যাটারিয়াল বিজ্ঞানের উপর পাঠদান করতে চান। একই সাথে তার আরেকটি লক্ষ্য রয়েছে- আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে ম্যাটেরিয়াল বিজ্ঞানের উপর গবেষণাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

এমআইটিতে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকা কালীন তাকিয়ান IEEE ম্যাগাজিন সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। এই দলে সারা বিশ্ব থেকে ৮৫ জন শিক্ষার্থী ছিলেন, যারা স্পেনে চৌম্বকীয় গবেষণার জন্য মনোনীত হয়েছিলো। দলের হয়ে একটি প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে তাকিয়ান ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, দিল্লিতে(IIT) ভ্রমণ করার সুযোগ পান।

তাকিয়ান বলেন, ‘IIT তে সফরের সময় আমি যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম তা হচ্ছে, এখানকার শিক্ষার্থীরা অতি অল্প যন্ত্রপাতি থাকা স্বত্বেও কতটা উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘IIT দিল্লির শিক্ষার্থীরা কিছু যন্ত্রপাতি স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করেন এবং কিছু আমদানি করেন। পরবর্তীতে তারা সবকিছুকে একসাথে করে একটি পুরো সিস্টেম চালু করে। তারা এটি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের চাইতে সুলভ মূল্য করে থাকেন। তাদের এমন উদ্যোগ আসলেই অনন্য। আমি বাংলাদেশে ফিরে এসে তাদের থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই।’

‘অধ্যয়নের বাহিরে যখন আমি কিছু অবসর সময় পেতাম তখন আমি বাংলাদেশী যেসব শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়ন করার জন্য আগ্রহ দেখাত তাদেরকে সহযোগিতা করতাম।’-তাকিয়ান এমনটি যোগ করেন।

তিনি বলেন, আমি সব মিলিয়ে ১০ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়ন করার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলাম। তাদের মধ্য ৬ জন শিক্ষার্থী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি গবেষণারত আছে।

তাকিয়ানের সহযোগিতায় এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮-১৯ সালের শিক্ষা বর্ষে একজন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে।

‘আমার অনুভূতি সত্যিই অনন্য, কারণ আমি ছিলাম বুয়েট থেকে এমআইটিতে ম্যাটেরিয়াল সাইন্সে অধ্যয়ন করতে আসা প্রথম কোনো শিক্ষার্থী। এটি সত্যিই সুন্দর একটি ব্যাপার যখন আপনি অন্য শিক্ষার্থীদেরকে তাদের স্বপ্ন সফল করতে সহযোগিতা করবেন।’-তাকিয়ান শেষে এমনটি জানান।

সূত্রঃ নিউজ ডট এমআইটি ডট এডু।