একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনে চলছে রদবদল। বিশেষ করে নির্বাচনসংশ্লিষ্টতা আছে, মাঠ প্রশাসনে কর্মরত এমন কর্মকর্তাদের বদলি বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ করা হচ্ছে। নির্বাচনকালে এসব কর্মকর্তা যেন সরকারের নির্দেশনা মেনে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেন, মূলত সেটিই রাখা হচ্ছে বিবেচনায়; যাচাই করে দেখা হচ্ছে দায়িত্ব পালনে তাদের অতীত রেকর্ড। এ বিষয়ে কাজ করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। কার্যত সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই রদবদলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। এদিকে, এ নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, ক্ষেত্রবিশেষে আতঙ্কও কাজ করছে। নির্বাচনের আগে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে চলমান এ রদবদল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, রদবদলে ব্যাপক দলীয়করণ চলছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, যেন সরকারি দল নির্বাচনকালে প্রয়োজন হলে ফায়দা নিতে পারে।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পর ১৫ দিন অতিক্রান্ত না-হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে পরামর্শ না করে বদলি করা যায় না। তবে এ সময়কালের আগে-পরে সরকারের রদবদল কার্যক্রমে ইসি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
সূত্র জানায়, ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনও, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং এসপি, থানাপুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও উপপরিদর্শক (এসআই) পদে রদবদল হয়ে থাকে। এসব কর্মকর্তা নির্বাচনকালে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গত ১৩ আগস্ট রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার নিয়োগ দেয় সরকার। এরও আগে গত ১০ জুলাই ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, নির্বাচন সামনে রেখে ইউএনওদের দাপ্তরিক কার্যক্রমের অতীত রেকর্ড দেখার পাশাপাশি দেখা হচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শও। এর পরই বেশ কয়েকটি উপজেলায় নতুন করে ইউএনও নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেড় শতাধিক কর্মকর্তাকে বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী করতে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে। একইভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে ডিসি, এসপি ও ওসিদের তথ্য। তবে এ তথ্যের বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতে নারাজ। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের অনেক সংসদ সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের নির্বাচনী এলাকার জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে পছন্দের বা অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে বা অপছন্দের কর্মকর্তাদের বদলি করে অন্যত্র সরিয়ে দিতে।
এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে সরকার তাদের পছন্দের কর্মকর্তা দিয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজাচ্ছেÑ এমন অভিযোগ এসেছে বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে। কেউ কেউ চলমান রদবদলকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সরকারের নীলনকশা বলেও অভিযোগ করছেন। যদিও সরকারের তরফে বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সরকার সব সময়ই নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তা দিয়ে প্রশাসন সাজায়। এতে করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না; নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা কমে যায়। একতরফা প্রশাসন সাজানো দেশের ভবিষ্যতের জন্য অশুভ বার্তা বয়ে আনে বলে মনে করেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, সরকার যেভাবে নিজেদের মতো করে প্রশাসন সাজাচ্ছে, তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা দিয়ে মাঠ প্রশাসন সাজাতে হবে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনে সরকারের এ ব্যাপক রদবদলের বিষয়ে এখন থেকেই ইসির নজর রাখা উচিত। সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক সেমিনারে এমন মন্তব্য করেছেন এক নির্বাচন পর্যবেক্ষক।
নির্বাচন পরিচালনায় ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডিসি-এসপিদের ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে হয় ইসিকে। জাতীয় নির্বাচনে জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন ডিসি; ইউএনও থাকেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে।
রদবদলের কড়চা
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, গত ৩১ জুলাই ১১ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তারা হলেনÑ মো. আসলাম হোসেন (কুষ্টিয়া), তন্ময় দাস (নোয়াখালী), এসএম ফেরদৌস (মানিকগঞ্জ), মো. ওয়াহিদুজ্জামান (ফেনী), মো. শহীদুল ইসলাম (খাগড়াছড়ি), এজেডএম নুরুল হক (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), বেগম নাজিয়া শিরিন (নীলফামারী), বেগম আনার কলি মাহাবুব (শেরপুর), মোহাম্মদ হেলাল হোসেন (খুলনা), মোহাম্মদ আবদুুল আহাদ (সুনামগঞ্জ) এবং মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম (বান্দরবান)। এর পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর আরও ১০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা হলেন- কবির মাহমুদ (বরগুনা), আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন (পিরোজপুর), হায়াত-উদ-দৌলা খান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মো. শহীদুল ইসলাম (টাঙ্গাইল), বেগম আনজুমান আরা (নড়াইল), মোহাম্মদ গোলামুর রহমান (নাটোর), গোপালচন্দ্র দাস (চুয়াডাঙ্গা), মো. আলী আকবর (মাগুরা), এসএম মোস্তফা কামাল (সাতক্ষীরা) এবং ফয়েজ আহমেদ (বগুড়া)। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর আরও ১০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক অতুল সরকারকে জয়পুরহাটে; ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর একান্ত সচিব সেবাস্টিন রেমাকে গাইবান্ধায় এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে সংযুক্ত উপসচিব সাবিনা ইয়াসমিনকে পঞ্চগড়ের ডিসি করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কাজী আবেদ হোসেনকে ঠাকুরগাঁও; সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরীকে পটুয়াখালী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব কেএম কামরুজ্জামান সেলিমকে চাঁদপুরের ডিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে সংযুক্ত উপসচিব মো. মাহমুদুল আলম দিনাজপুরের; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংযুক্ত উপসচিব আতাউল গণি মেহেরপুরের; ভূমিমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন কুড়িগ্রামের এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এম কাজী এমদাদুল ইসলাম সিলেটের ডিসি হয়েছেন। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ডিসিদের নির্বাচনের আগে ফের বদলির সম্ভাবনা নেই বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা।