ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ জন্য তারা জাতীয় ঐক্যমত গঠনের অঙ্গীকার করেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভূখণ্ড কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে না দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে তারা।
রবিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত জনসভায় এই কথা জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের মুক্তিসহ আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রীক নানা দাবিতে এই সমাবেশ ডাকে বিএনপি।
প্রায় এক বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সমাবেশকে ঘিরে নেতা-কর্মীদের উৎসাহ ছিল ব্যাপক। এই সমাবেশে আলোচিত জাতীয় ঐক্য এবং আগামী নির্বাচন বিষয়ে কী ঘোষণা আসে, সে নিয়ে দৃষ্টি ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনের। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নতুন করে কোনো বক্তব্য আসেনি।
যদিও দলের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সাতদফা দাবি এবং ক্ষমতায় গেলে কী করবে বিএনপি ১২ দফা ঘোষণা করেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গতকাল আমাদের একজন আইনজীবী কারাগারে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে দেখা করেছেন। তিনি খুবই অসুস্থ। তার পরেও তিনি আমাদেরকে, আপনাদেরকে বলেছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।’
অবশ্য এই সমাবেশেই বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন নেতা শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠানোর হুঁশিয়ারি দেন।
ফখরুলও বলেন, ‘সারাদেশে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। আগামীতে এসব মামলা যদি মিথ্যা প্রমাণ হয়, তাহলে সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কেউ রক্ষা পাবে না।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকার ভয় পেয়েছে, তারা রাতে স্বপ্নের মধ্যে খালেদা জিয়া, খালেদা জিয়া, বিএনপি, বিএনপি করছে।’
সমাবেশে সাত দফা দাবি তুলে আগামী ৩ অক্টোবর সব জেলা শহরে এবং ৪ অক্টোবর মহানগরে সমাবেশ এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দেয়ার ঘোষণাও দেন মির্জা ফখরুল।
বলেন, ‘সরকার যদি দাবি মেনে না নেয় তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করা হবে। খালেদা জিয়ার ডাকে দেশবাসী এবং সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সরকার ভীষণ ভয়ে আছে। তারা এখন পদে পদে ষড়যন্ত্রের ভূত দেখতে শুরু করেছে।’
জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নাম ঘোষণা করা হয়। কারাবন্দী থাকলেও তার জন্য মঞ্চে চেয়ার রাখা হয়েছিল।
এতে প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
বিএনপির ১২লক্ষ্য
ক্ষমতায় যেতে পারলে বিএনপি কী করতে যায়, তার বর্ণনা দেন ফখরুল।
এগুলো হলো: ১. জনগণের ভোটে যদি নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা।
২. সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলীয়করণের ধারার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।
৩. রাষ্ট্র ক্ষমতায় গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
৪. স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করা।
৫. দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আধুনিক, শক্তিশালী ও কার্যযকর করা।
৬. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
৭. কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অধিকতর কার্যকর করা।
৮. সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা।
৯. সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরীতা নয় এই মূলনীতিকে অনুসরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণ করে স্বাধীনতা ও পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশী হিসেবে সবক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১০. কোনো ধরণের সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় না দেয়া, জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভুখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ না দেয়া।
১১. নিম্ন আয়ের মানুষের মানবিক জীবনমান নিশ্চিত করা, সঙ্গতিপূর্ণ বেতন মজুরি নির্ধারণ ও আয় বৈষম্য অবসানকল্পে সমতাভিত্তিক নীতি গ্রহণ এবং সকলের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
স্নাতক পর্যায় পর্যযন্ত অবৈতনিক এবং উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে জীবনমুখী শিক্ষানীতি চালু, জাতীয় উন্নয়নে সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সকলের জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তৈরি পোশাক শিল্পের অব্যাহত উন্নয়ন এবং শিল্প ও রপ্তানি খাতকে বহুমুখী করা।
১২. সকল প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসানে জাতীয় ঐক্যমত গঠন করবে বিএনপি।
জনসভা থেকে এসব দাবি আদায়ে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলেও ঘোষণা দেন ফখরুল।
বিএনপির সাত দফা দাবি
সমাবেশে তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার, তারেক রহমানসহ সব সব রাজবন্দীর ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবি জানানো হয়।
অন্য দাবির মধ্যে আছে, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা করা, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে প্রতিটি কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহার না করা।
নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যবেক্ষকদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে কোনো রকম বিধিনিষেধ আরোপ না করা, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মামলা বাতিল, তফসিল ঘোষণার পর মামলা স্থগিত রাখা হবে এবং নতুন করে মামলা না দেয়া, পুরানো মামলায় কাউকে আটক না করা, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্বাধীন মত প্রকাশের ঘটনায় যেসব যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করে তাদের মুক্তি দিতে হবে।
ঢাকাটাইমস