২৯ মার্চ, ২০১৬: আদালতের রায়ে শাস্তি পাওয়ার পরও মন্ত্রিত্ব ছাড়ছেন না খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সাজার বিষয়টি সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। তবে আইন ও সংবিধানে তাদের মন্ত্রিত্বের জন্য কোনো বাধা না থাকায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কোনো সিদ্ধান্তও দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে মন্ত্রীদের শপথ ভঙ্গের বিষয়ে কী ধরনের মন্তব্য করা হয়— তা দেখার অপেক্ষা করা হচ্ছে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে। এর আগে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি দুই মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সকালে দুই মন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে দুপুরে অফিসও করেন।
পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন দুই মন্ত্রীই। দুই মন্ত্রীই অপেক্ষা করছেন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপির জন্য। রায়ের কপি হাতে পেলে আইন মোতাবেক পদক্ষেপ নেবেন। অবশ্য দোষী প্রমাণিত দুই মন্ত্রীর স্বপদে বহাল রাখা কেন অবৈধ, অসাংবাবিধানিক ও রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হবে না, তা জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে গতকাল বিকালে পাঠানো হয়েছে আইনি নোটিস। জানা যায়, আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত দুই মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হক মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে যোগ দিতে গতকাল বেলা ১১টার আগেই আলাদাভাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলনকক্ষে প্রবেশ করেন। সভার ধারণ করা ভিডিওচিত্রেও তাদের নিজ নিজ আসনে বসে বৈঠকে অংশ নিতে দেখা যায়। দুই মন্ত্রী বৈঠকে অন্যান্য দিনের মতো অংশ নিয়েছেন। বৈঠকে তাদের বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়নি। বৈঠক শেষে বেরিয়েই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিলেও অভিযুক্ত দুই মন্ত্রী সেখানে কোনো কথা বলেননি। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নিজ দফতরে ফিরে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। খাদ্যমন্ত্রী জানান, আপিল বিভাগের রায়ের কপি হাতে পেলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আলোচনা করেই পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়ে রিভিউ করা হবে। কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজেও একজন আইনজীবী। আমার নিজেরও চিন্তাভাবনা আছে। আর আপিল বিভাগের রায়ের কপি হাতে পেলেই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’ তবে জরিমানা ও সাত দিনের কারাদণ্ডের পর তিনি মন্ত্রী পদে থাকবেন কিনা— এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি খাদ্যমন্ত্রী। সর্বোচ্চ আদালতের দণ্ডের পর তার শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা— এর উত্তরে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন আইনমন্ত্রী।’ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নিজ দফতরে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর আবার দুপুরে নিজ মন্ত্রণালয়ে যান। দুপুরেও ঘণ্টাখানেক নিজ কক্ষে কাটিয়ে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বিকালে গাজীপুরে নির্বাচনী এলাকায় নির্ধারিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে মন্ত্রণালয় ত্যাগ করেন। এর মধ্যে একাধিকবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অবশ্য এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘শুরু থেকেই দুই মন্ত্রীর বেশি কথা বলার ব্যাপারটি দলের সর্বোচ্চ ফোরাম ভালোভাবে নেয়নি। কারণ দেশের প্রধান বিচারপতি প্রতিষ্ঠান। তার ব্যাপারে কোনো সুইপিং রিমার্কস করা সংগত নয়, সমীচীন নয়।’ দুই মন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকবেন কিনা— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটি তাদের নৈতিক বিষয়। সহকর্মী হিসেবে আমি তাদের পদত্যাগ দাবি করতে পারি না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিষয়টি নিয়ে সরকার বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছে।’ সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে কিনা এটা হুট করে বলার মতো বিষয় নয় বলেও মন্তব্য করেন সেতুমন্ত্রী। তবে শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আইনমন্ত্রীই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।’ পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘একদমই পরিষ্কার, এখানে সংবিধান ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো ব্যাপার নাই। এখানে পদত্যাগ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। আদালতের রায়টি শপথ ভঙ্গের কোনো বিষয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। সর্বোচ্চ আদালতের দণ্ডাদেশের পর মন্ত্রী পদে থাকার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তবে এখানে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। মন্ত্রী পদ থেকে তারা পদত্যাগ করবেন কিনা, তা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
সংবিধানপ্রণেতা ও প্রবীণ আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সুস্থ বিচারবুদ্ধির বিবেচনায় দোষী প্রমাণিত ব্যক্তিদের অবশ্যই তাদের সুবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সরে দাঁড়ানো উচিত। আদালতে দোষী প্রমাণিত ব্যক্তি নৈতিকভাবে সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না।’ মন্ত্রীদের সংবিধান ও শপথ ভঙ্গ হওয়ার কোনো বিষয় আছে কিনা তা আজ খতিয়ে দেখবেন জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যম বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে।’ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ‘আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেছেন মর্মে উল্লেখ করা হলে, আইনের সূক্ষ্ম বিচারে সরকারপ্রধান কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত সংবিধানে এরূপ পরিস্থিতিতে তাদের মন্ত্রী পদে বহাল থাকাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি।’ গত ৫ মার্চ রাজধানীতে এক সেমিনারে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হক। প্রধান বিচারপতি তার আসনে থাকতে চাইলে ‘অতিকথন’ বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন এক মন্ত্রী। একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর মামলায় আপিল বিভাগের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি যেসব মন্তব্য করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে ওই মামলায় পুনরায় শুনানি করার আহ্বান জানান দুই মন্ত্রী। ওই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এ দুই মন্ত্রী। এ জন্য তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে সাত দিনের কারাদণ্ড দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
আইনি নোটিস : দুই মন্ত্রীর স্বপদে বহাল রাখা কেন অবৈধ, অসাংবাবিধানিক ও রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হবে না— তা জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে গতকাল বিকালে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জুলফিকার আলী জুনুর ডাকযোগে পাঠানো নোটিসে বলা হয় : আপিল বিভাগে খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। এ অবস্থায় দুই মন্ত্রীই দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তারা স্বপদে বহাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় পতাকা ব্যবহার করে অবাধে চলাফেরা করছেন, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক, যা দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জনস্বার্থে লিখিত আকারে জানানোর জন্য এবং প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। তা না হলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়া উচিত : দেশের উচ্চ আদালতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মন্ত্রী দণ্ডিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। সেই সঙ্গে বর্তমান মন্ত্রিসভা থেকে সব মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না। শুধু নৌকা মার্কার ভোট হচ্ছে। এ জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। সংগঠনটির সিনিয়র সহসভাপতি মুহাম্মদ মুনির হোসেনের সভাপতিত্বে দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা প্রমুখ।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন