২৫ মার্চ ২০১৬: আজ সেই কালরাত… । পচিঁশে মার্চ । বাঙ্গলীর জীবনে এক দগ দগে ঘাঁ । যে ঘাঁ ইচ্ছে করলেও কোন দিন মুছে ফেলা যাবেনা । ১৯৭১ সালের এই দিন রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় রক্তপিপাসু হিংস্র পাকিস্তানি হানাদার দল। অপারেশন সার্চলাইটের নামে এ রাতে তারা মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে পুরো ঢাকা শহরকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষদের ওপর চালায় গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতন। এ থেকে রেহাই পাননি ছাত্র, শিক্ষক, নারী, শিশু এমনকি রিকশাচালকও। স্বাধীনতাকামী বাঙালির স্বাধীনতা স্পৃহা চিরতরে মুছে দেয়ার জন্য ঢাকার বাইরেও চলেছে গণহত্যা। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ রাতটি কালরাত হিসেবে পরিচিত। একটি স্বাধীনতাকামী জাতির স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে হায়েনার হিংস্র নখরে ক্ষত-বিক্ষত হয় মানবতা।
রাত ১ টায় শুরু হয় পাকবাহিনীর বরর্বরোচিত উন্মত্ততা। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের নাম ছিল ”অপারেশন সার্চলাইট” । এই ব্লু প্রিন্ট বাস্তবায়ন করতে ঢাকায় ডেকে আনা হয় ”বেলুচিস্তানের কসাই ” খ্যাত জেনারেল টিক্কা খান কে । এ রাতে লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক কলোনি, পুলিশ, ইপিআর ব্যারাকসহ আবাসিক এলাকা এবং বস্তিবাসীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে শুরু করেছিল বিশ্ব ইতিহাসের নজিরবিহীন গণহত্যা, নিপীড়ন ও অত্যাচার। এ হত্যাযজ্ঞে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল বিশ্ববিবেক।
২৫ মার্চের সে ভয়াল রাতে পুরো ঢাক শহর যেন এক মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। শহরের রাজপথে, গলির মুখে, বড় দালানের সিঁড়িতে কিংবা জনঅধ্যূষিত বস্তির মোড়ে লাশের স্তূপ পড়েছিল। ঢাকায় “অপারেশন সার্চ লাইটের” লক্ষ্য ছিল পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, নীলক্ষেত, রেল লাইনের দুইধারের বস্তি বাসিন্দারা, রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, নিউমার্কেট, ঠাঠারি বাজার, পুরনো ঢাকার হিন্দু এলাকাসমূহ, ফরাশগঞ্জ, বি. কে. দাস লেন, শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার, ভোলা গিরি আশ্রম, অভয়দাশ লেন, টিকাটুলি, হাটখোলা, আর কে মিশন রোড, গেন্ডারিয়া আর সাধনা ঔষধালয় এলাকায় বসবাসরতরা। তা ছাড়া ছিল স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলকেন্দ্র বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাড়ি ও গভর্নর হাউজের বাসিন্দারা। সে রাতে পাকিস্তানিরা কমপক্ষে ১০ হাজারের মতো নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। শুধু রাজারবাগ পুলিশ স্টেশনে তারা হত্যা করেছে ৫ শতাধিক পুলিশ যোদ্ধা আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন করেছে ৩ শতাধিক নিরীহ ছাত্র। তারা শুধু এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনার মধ্যেই থেমে থাকেনি। গ্রেপ্তার করেছিল লেখক, রাজনৈতিক নেতা সহ গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি সামরিক অফিসারদের। পশ্চিমের জেনারেলদের লক্ষ্য ছিলো ২৬ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের বড় বড় শহর দখল করে ফেলা। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমূলে উৎপাটন করা। তাই তারা এদিন রাতে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম সামরিক অপারেশন ‘অপারেশনসার্চ লাইট’ পরিচালনা করে। এ হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জেনোসাইড। যে হত্যার শিকার হয়েছিলেন স্বাধীনচেতা ও মুক্তিকামি নাগরিকরা।
২৫ মার্চের গণহত্যা যেমন নাড়া দিয়েছিলো বিশ্ব বিবেক, তেমনি এই হত্যাযজ্ঞ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তরান্বিত করে। এই গণহত্যা বাঙালিদের ক্রুদ্ধ করে তোলে, বাঙালি সেনাপতি ও সৈনিকেরা সাধারণ জনতার সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর পরের নয় মাস ছিল দেশজুড়ে পাক সেনা ও রাজাকারদের চালানো বর্বরোচিত হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, জ্বালাও-পোড়াও অভিযানের বিপরীতে আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ। পাক সামরিক জান্তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে বহু মানুষকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে হয় ভারতে।
মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রাম, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড– মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আসে আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলায় সগৌরবে ওড়ে লাল-সবুজ মুক্তির পতাকা।